পদ্মমির পর্ব ৫
এই সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য পরিচিত হওয়ায় পদ্মজার সিনেমাটি খুব পছন্দের তা অজানা নয় আমিরের।যেহেতু লিখনের সঙ্গে পদ্মজার একটা অতীত আছে তাই আমিরের কথা ভেবে পদ্মজা টিভি বন্ধ করে দিতে চাইলে আমির তাকে বাধা দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘সেসব অতীত। এখন লিখন শাহ শুধুমাত্র একজন অভিনেতা। বিনোদনের জন্য আমরা তার সিনেমা দেখতেই পারি। ‘
এক টুকরো শুভ্র, শীতল মেঘ যেন পদ্মজার হৃদয় ছুয়ে গেল। ও মুখ তুলে এক নজর আমিরকে দেখে ভাবল, ‘কি মহৎ চিন্তাধারা! মানুষটা কত সরল মনে কোন প্যাচ নেই। সবকিছু হাসিমুখে মেনে নেয়। ‘
আমির উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘দেখো, দেখো তোমাদের টমেটো গাছগুলো দেখাচ্ছে। ‘
পদ্মজা টিভির দিকে তাকায়। সিনেমায় এখন তাদের বাড়ির দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছে। ও দুই চোখ ভরে নিজের বাড়ির আনাচেকানাচ দেখছে।
দেখলো না শুধু, আমিরের বেঁকে যাওয়া দুটি ভ্রু।লিখনের মুখ, কন্ঠের স্বর, নড়াচড়া ঈর্ষার ঢেউ তুলছে বুকে! পদ্মজার প্রথম ভালোলাগা এই পুরুষ মানুষটি! লিখন নিজের সীমা জানে। কখনো নিজের সীমা অতিক্রম করেনি।তবুও আমির তাকে ঈর্ষা করে। লিখনের এই ভালোমানুষির জন্য পদ্মজা তাকে খুব সম্মান করে। আমির ভাবে, ওর সম্মানের ভাগ হয়ে গেছে। ও মানতে পারেনা। হাত নিশপিশ করে, লিখনের গলা টিপে ধরতে।
সিনেমা শেষ হতে আরও দেড় ঘন্টা বাকি।এতক্ষণ লিখন শাহকে সহ্য করা আমিরের পক্ষে সম্ভব নয়।ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়, পদ্মজার জন্য পুরো আলন্দপুর সবকিছু সিডিতে আনার ব্যবস্থা করবে। পদ্মজা যা চায় তাই সে দিবে।তবে এই সিনেমা আর নয়। ও টয়লেটের কথা বলে রুমে গিয়ে কাউকে টেলিফোন করে বলল, পাঁচ মিনিট পর পুরো এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে।
বেজে উঠলো ইন্টারকম।
সেক্রেটারির গালা,’মি.হাওলাদার রফিক মাওলা এসেছেন
আপনার সঙ্গে দেখা করতে ‘-
এমপি কুতুবউদ্দিনের চামচা রফিক মাওলা!তার বয়স সাঁইত্রিশ। চুলের রঙ কালো, গায়ের রং ফর্সা, মোটা নাক, পরনে কালো রঙের স্যুট, আকাশি রঙের শার্ট এবং চামড়ার জুতা। তার মধ্যে ইবলিশের ছায়া আছে। দেখলেই মনে হয় অশুভ প্রতীক।
এদের হাত ধরে আমিরের শহুরের নারী ব্যবসা সূচনা হয়েছিল। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারি হবার পর আমির নিজের আলাদা ব্যবসা শুরু করতে চাইলে কুতুবউদ্দিনের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। আমির তাদের আড়ালে নিজের একটা দল তৈরি করেছিল তাই কুতুবউদ্দিন তার হাটু ভেঙে দিতে পারেনি। তাদের মধ্যকার লড়াই যখন তীব্র আকার ধারণ করে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হামিদ খান ফয়সালার মাধ্যমে দুজনের লড়াই থামিয়ে নিজেদের মত কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগ।
তারপর থেকে নিশ্চুপে নারী ব্যবসা নিয়ে দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। আমির দেশের সাধারণ নাগরিক হয়েও নিজের চতুরতা, বুদ্ধিমত্তার কারণে এমপি কুতুবউদ্দিন এর ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দিতা করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠে। কেউ কারো থেকে কম নয়। ইয়াকিসাফির হেরেম তৈরির জন্য নারী সংগ্রহের দায়িত্ব প্রথম কুতুবউদ্দিনের হয়ে রফিক মওলার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন আমির উপস্থিত হলো,ইয়াকিসাফি মত পরিবর্তন করে দায়িত্ব আমিরকে দিয়ে দিল। আমির সেদিন পৈশাচিক হাসি হেসেছিল। তাদের গত পাঁচ বছরের আয় এই একটি চুক্তির আয়ের সমান!কুতুবউদ্দিন ভেবেছিল, এই টাকায় নিজের জাহাজের ব্যবসাকে আরো বড় করবে। অন্যদিকে আমিরের পরিকল্পনা এই টাকায় এয়ারলাইনের ব্যবসা শুরু করার।
গত নয় বছর যাবত কুতুবউদ্দিন কিংবা তার চামচা রফিক মাওলার সঙ্গে আমিরের সরাসরি বাক্য আদান-প্রদান হয়নি।আজ রফিক মামলা কেন এসেছে? তাও এই অফিসে।
এখানে পণ্যের রপ্তানি নিয়ে যাবতীয় কার্যক্রম চলে। বিয়ের আগে ব্যবসায় লাভ ছিল তবে এতটা নয়। পদ্মজাকে শহরে নিয়ে আসার পর,সে ব্যবসা নিয়ে খুব আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। তার আগ্রহকে মূল্য দিতে গিয়ে আমির ব্যবসায় সময় বাড়িয়ে দেয়। লাভ হতে থাকে চারদিক থেকে। এক বছর হলো নিজরা পন্য তৈরি করে রপ্তানি দিচ্ছে।ব্যবসার গুণগান সর্বত্র ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে। গোডাউনের পাশাপাশি এখন তাদের একটি ফ্যাক্টরিও রয়েছে।গত পাঁচ বছরের বাংলাদেশের সফল ব্যবসায়ীর কাতারে চলে এসেছে আমির হাওলাদার। তার ছায়াতলে অনেক শ্রমিক কাজ করে। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রত্যেকের সাধারণ সৎ কর্মচারী মাত্র। ব্যবসার আড়ালে কি চলে সে সম্পর্কে কেউ জানে না।
আমিরের দ্বিতীয় অফিস অন্য এলাকায়। নারী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিংবা অন্য কোন অপরাধ জগতের বাসিন্দা-প্রত্যেকে ওখানে দেখা করতে যায়।
আমির সেক্রেটারিকে ভারিক্কি গলায় বলল,’ তাকে আসতে দিবেন না।’ইন্টারকমের সুইচ অফ করে দিল ও।
আলমগীর সহ আরোও ছয়জন আমিরের অফিসে ঢুকল।দ্বিতীয় অফিসে যাবার সময় হবে না বলে তাদেরকে আমির এখানে ডেকেছি কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।কে কোন এলাকায় যাবে, কিভাবে কি করবে তার একটা ছক তৈরি করেছে।প্রত্যেকের হাতে তা তুলে দিবে। আলমগীরের পাশে কবির দাঁড়িয়ে আছে ;তেইশ বছরের তরুণ।বছর কয়েক আগে কবিরকে পথ থেকে তুলে এনেছিল আমির।
মাতালের মতো চোখ বুজে আসছে বারবার,ঢলছে সে।
আমির কপাল কুঞ্চন করে বলল,’ওর কি হলো? ‘
কবির ধপাৎ করে আলমগীরের গায়ের উপর পড়ে যায়।
আলমগীর দ্রুত ধরে ফেলল,’বেশি গিলে ফেলছে। ‘
কবির জড়ানো গলায় বলে,’আমি শুনতাছি। খালি দাঁড়াইতে পারতাছিনা, পা দুইটা কই জানি চইল্লা গেছে।আপনি কন, আমি শুনতাছি, শুনতাছি -‘
আমির গর্জে উঠল,’ঘাড় ধরে ওকে বের করে দাও। ‘আবার বাজল ইন্টারকম।
সেক্রেটারি বিনীত সুরে বলল, ‘ আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। রফিক মাওলা বলেছেন তিনি আপনার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলতে চান। ‘
তৎক্ষণিক আমিরের শরীরের স্নায়ুতে টান পড়ল।রগে রগে কিছু একটা ছুটতে শুরু করল। রফিক মাওলা পদ্মজা সম্পর্কে কি বলবে? ভালো কিছু নয় তা নিশ্চিত। আমির বলল,’ ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
তার চোখমুখে রং পরিবর্তন হতে দেখে আলমগীর প্রশ্ন করল,’কি হয়েছে?’
‘ রফিক মাওলা অফিসে। ‘
‘ ও এখানে কি করে? ‘
‘ পদ্মজাকে নিয়ে কিছু বলতে চায়।’
কবির ছাড়া উপস্থিত বাকি ছয়জনের মুখে উৎসাহ ছড়িয়ে পড়ে। এরা প্রত্যেকে আমিরের বিশ্বস্ত সঙ্গী। একেকজন একেক দলের দলনেতা হয়ে কাজ করে। পদ্মজা সম্পর্কে সব জানে। পাঁচটি বছর পদ্মজার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার যে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আমিরের,তাতে এদেরও অবদান রয়েছে।
আমির কোথাও গেলে তারাই পদ্মজাকে আড়াল থেকে রক্ষা করে।তাদের নাম সাদিক,সুরুজ,আবুল,আসাদসারওয়ার, কবির ও আলমগীর।
রফিক মাওলা অফিসে ঢুকল।প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকানো চারিদিকে। চাকচিক্য এবং অভিজাত্যপূর্ণ অফিস।
দাঁত বের করে হেসে বলল,’ বহুদিন পর দেখা মি.হাওলাদার। ‘
আমিরের সোজাসাপটা প্রশ্ন,’ কি বলতে চান?’
রফিক বাকিদের দেখে বলল,’ এদের সামনেই বলব?’
‘ দ্রুত বলুন, আমার কাজ আছে। ‘তাড়া দিল আমির। পদ্মজার নাম উঠায় অস্থিরবোধ করছে সে।
‘ আগে তো বসতে দিন।’
আমির ও রফিকের কাছাকাছি বয়স।এক সময় দুজনের মধ্যে মহব্বত ছিল। একে অপরকে তুই বলে সম্বোধন করত।সেই সম্পর্ক আর নেই।
এখন দুজন দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বী, শত্রু।
আমিরের মুখোমুখি একটি চেয়ার দখল করে বসল রফিক। বলল,’ ভাবি কেমন আছে?শরীর ভালো আছে তো? ‘
রফিকের মুখে পদ্মজার সম্পর্কে কিছু শুনতে চাচ্ছে না আমির।এতটাই অস্থির হয়ে পড়েছে যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
রফিক পুনরায় বলল,’ ভাবির নাকি জ্বর এসেছিল,এখন ঠিক আছে?’
আমির কটমট করে তাকিয়ে আছে। তার হয়ে আলমগীর বলল,’হেঁয়ালি ছাড়ুন। কি বলতে চান? কাজের কথায় আসুন।’
রফিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,’ ভাবির সম্পর্কে বলতে চাই।’
রফিক পদ্মজার সম্পর্কে কিছু বলতে চায় শোনার পর থেকে আমিরের রক্ত টগবগ করছে। সে গর্জে উঠার আগের রফিক বলল,’ ভাবিকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।তবে শুনলাম, ভাবি নাকি …’রফিক থামল।
আমিরের দিকে তাকিয়ে ফিচলে হাসল।আমির মনে মনে ভাবছে,’রফিক যেন এটা না বলে,ও জেনে গেছে পদ্মজা আমার ব্যবসা সম্পর্কে কিছু জানেনা। তাহলে শত্রুপক্ষরা আমাকে ধ্বংস করার মোক্ষম হাতিয়ার পেয়ে যাবে। এটা যেন না হয়, না হয়!’
কিন্তু তাই হলো।রফিক নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,’ ভাবির থেকে আড়াল করা কি ঠিক হচ্ছে?অর্ধাঙ্গীর তো সব জানা উচিত। সে জানবে না তোকে জানবে? ভাবির সাথে অবিচার হচ্ছে। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
বুঝেও না বুঝার ভান ধরে আমির বলল,’ কি জানার কথা বলছেন?’
রফিক নিষ্পাপ গলায় বলল,’ অতীতের ফষ্টিনষ্টি, দুইটা বউ, নারী ব্যবসা, এত বড় একটা চক্র-‘
আমির কথার মাঝে উত্তেজিত হয়ে পূর্বের সম্বোধনে চলে আসল,’ বেরিয়ে যা কুত্তার বাচ্চা।এক্ষুনি বেরিয়ে যা। ‘
আলমগীর, সাদিক দুজন মিলে রফিক কে বগল থাবা দিয়ে ধরে বের করে দেওয়ার জন্য। রফিক ঠোঁটে বাঁকা হাসি এঁটে বলল,’ আশা করি ভাবি তার স্বামীর গল্পটা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনবে। ‘
আমিরের চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। বুকের ভেতর ধিকধিক করে জ্বলছে আগুন। রফিক মাওলা জানে মানে কুতুবউদ্দিন ও জানে।সে ফেসে গেছে। পাথর হয়ে গেছে আমির।দ্রুত আলমগীরকে থামিয়ে দিয়ে দুর্বল ও কর্কশ গলায় বলল,’ কি চাস?’
রফিক বিজয়ের হাসি হাসল।দুই হাত ঝেড়ে আবার চেয়ারে বসে পেশাগত ভঙ্গিতে বলল,’ স্যার বলেছেন, ইয়ারকিসাফির সঙ্গে যে চুক্তিপত্র করেছেন সেটি যেন আপনি বাতিল করেন। আপনার পশ্চিমের জায়গাটাও চান, যেখানে আপনি আরেকটা ফ্যাক্টরি করতে চাচ্ছেন।স্যার সেখানে শপিং মল করবেন আর চারটি জাহাজ চাই
চলবে?
সম্পূর্ণ গল্প