#পুকুর রহস্য
পর্ব ২
কিন্তু আমাদের বাড়ির কেউই বড়চাচার কথাটা তেমন গভীরভাবে নিচ্ছে না। আমার দাদী আব্বাকে বললেন,”যাও আশরাফ, তোমার দায়িত্ব গ্রামের সব বাড়িতে যেয়ে যেয়ে সবাইকে নিমন্ত্রণ জানানো। সরদার বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। গ্রামের একটা ঘরও যেনো বাদ না যায় দাওয়াত পেতে। আর হ্যা, বলবে কোনো উপহারের দরকার নেই। সবাই যেনো মন ভরে দোয়া করে যায় মেয়ে জামাইকে।”
আব্বা আমতা আমতা করে বললেন,”আম্মা, বড় ভাইজানের কথা শুনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কি উচিত হবে? না মানে বলছিলাম, পাত্রপক্ষ এখনো কিছু জানায়নি। এখন যদি তারা বরাবরের মতো না করে দেয়, তখন গ্রামের মানুষের সামনে সরদার বাড়ির মানসম্মান কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন? যে সরদার বাড়ির সদস্যদের সামনে কেউ চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায়না, যদি বিয়েটা শেষ পর্যন্ত না হয় সবাই তো উপহাস করা শুরু করবে আমাদের। আমাদের কি ভাইজানের কথা শুনে এভাবে এগোনো ঠিক হবে?”
কথাগুলো বলে আব্বা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাদীর দিকে তাকালেন। দাদী ভ্রু কুঁচকে আব্বার দিকে তাকিয়ে বললেন,”তাই নাকি আশরাফ? সরদার বাড়ির পুকুরের পুরোনো ইতিহাস কি তুমি ভুলে গিয়েছো? পুনরায় মনে করিয়ে দিতে হবে?”
সাথে সাথে আব্বার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। থরথর করে কাঁপতে থাকলেন।
এই ব্যাপারে আমাদের পুকুরের কিছুটা পুরোনো ইতিহাস বলে রাখা ভালো। আমি তখন ছোট, মাত্রই হাঁটা শিখেছি। আমার ছোট ভাই রাজের তখন জন্ম হয়নি। আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদার। দাদাজানের আব্বা বা তারও আগ থেকেই আমাদের জমিদারি। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমার চাচারা বা আব্বা আস্তে আস্তে জমিদারি থেকে সরে আসেন। তাদের গঞ্জে সুবিশাল কাপড়ের ব্যবসা। আব্বাদের তিন ভাইয়ের গঞ্জে মোট ছাব্বিশ খানা কাপড়ের দোকান। যেগুলোর তত্ত্বাবধায়ন তারা তিন ভাই আর আমার বড়দা (বড় চাচার ছেলে) রায়হান করেন। এছাড়াও প্রচুর কর্মচারী রয়েছে। আমার মেজো চাচার ছেলে সেজান এসবের ধারেকাছেও যায়না। যাই হোক, এই কাপড়ের ব্যবসা মূলত আমার দাদাজানই শুরু করেন। কিন্তু এরমধ্যে আমাদের বাড়িতে কিছুটা সমস্যা শুরু হয়। সমস্যাটা মূলত আমার আব্বাকেই কেন্দ্র করে। আমার দাদাজান তখন সবে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি যতোদিন বেঁচে ছিলেন তিনি তাঁর তিন ছেলেকে আগলে রেখেছেন। কিন্তু তিনি মারা যাবার পর থেকেই আমার আব্বা কিছুটা খারাপ সঙ্গে পড়ে যান। দোকানপাট, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রতি কোনো মন ছিলো না তখন তার। খারাপ সঙ্গে পড়ে মদ,জুয়াও ধরেন। আমি তখন ছোট, এতো কিছু বুঝিনা। আমার দাদী বুঝতে পেরে আব্বাকে অনেক শাসন করেন। এমনকি এতো বড় ছেলের গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন। কিন্তু কোনোভাবেই আব্বাকে সেসব খারাপ কাজ থেকে সরিয়ে আনা যাচ্ছিলো না। তিনি বড় চাচা বা মেজো চাচা দোকানে না থাকলে দোকানের ক্যাশ থেকে প্রচুর টাকা তুলে নিয়ে চলে যেতেন। শেষমেশ আমার দুই চাচা রেগে যেয়ে আব্বার দোকানে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন। তাতে আব্বা যেনো আরো ক্ষুব্ধ আর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন টাকার জন্য। প্রায় রাতে আম্মার সাথে ঝগড়া করতেন টাকার জন্য। আম্মা ছোট্ট আমিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। আমার যদিও এসব কিছুই মনে নেই। আমি বড় হলে আম্মা এসব আমাকে বলেছেন।
এভাবেই চলছিলো দিনগুলো। আমার দাদী বা চাচারা কেউ আব্বাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না। গ্রামের লোকেরাও অনেক কিছু জানতে শুরু করেছিলো। দাদী ভীষণ দুশ্চিন্তা করতেন সবসময় সরদার বাড়ির মানসম্মান নিয়ে। এরই মধ্যে একদিন আব্বা সারারাত জুয়া খেলে হাতের টাকা সব শেষ করে বাড়ির দিকে আসছিলেন আম্মার গয়না নিয়ে যেতে, যা বিক্রি করে আবার যাবেন তিনি। তখন রাত প্রায় চারটা বাজে। ফজরের আজান দেয়নি তখনো। চারদিকে রাতের অন্ধকার, আলো ফোটেনি তখনও। আব্বার কাছে মূল ফটকের চাবি থাকতো। আব্বা গেট খুলে আমাদের উঠোনটায় পা দিতেই তিনি দেখলেন আমাদের বাড়ির আঙিনা যেনো দিনের আলোর মতো আলোয় ফকফক করছে। সেদিন পূর্নিমাও ছিলো না। সারা রাস্তায় আব্বা দেখেছেন অন্ধকার। হঠাৎ বাড়ির মধ্যে এতো আলো কোথা থেকে আসলো। আব্বা কিছুটা কৌতুহল হয়ে এদিকে সেদিকে আলোর উৎস খুঁজতে লাগলেন। তখন তিনি বুঝলেন আলোটা আসছে আমাদের পুকুর থেকে।
আব্বা আস্তে আস্তে পুকুরের দিকে পা বাড়ান। যতোই তিনি সেদিকে যান, ততই যেনো আলোর তীব্রতায় চোখ ঝলসে আসে তার। পুরো বাড়ির শ খানিক লাইট জ্বালালেও বুঝি এতো আলো হওয়া সম্ভব নয়। পুকুরের পাড়ে আসতেই আব্বা থমকে দাঁড়ান। তিনি চোখ কচলে আবার তাকান পুকুরের দিকে। ঠিক দেখছেন তো? নাকি কোনো ভ্রম? বার বার চোখ কচলে দেখার পর তিনি নিশ্চিত হলেন যে তিনি ঠিক দেখছেন। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? পুকুরের টলটলে স্বচ্ছ পানির উপর একগাছা স্বর্ণের পাতা। যার শিকড় পানির নিচে। এই পাতাগুলো থেকেই এমন আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। কোনো স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ হলে তিনি বুঝতে পারতেন এটা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। কিন্তু আমার আব্বা তখন স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। তার প্রচুর টাকার দরকার তখন। তিনি বুকে ফুঁ দিয়ে আস্তে আস্তে পানিতে নেমে পড়েন ওই পাতা নেওয়ার উদ্দেশ্য।
কিন্তু যতই পাতা তুলতে যান ততই যেনো পানির নিচে শিকড়ে টান পড়ে। ব্যাপারটা এমন যে, পানির নিচ থেকে শিকড় টেনে না আনলে পাতা উঠানো যাবে না। আমার আব্বাও সেই শিকড় টানতে টানতে পানির নিচের দিকে যেতে থাকেন। যত নিচে যান, শিকড় যেনো তত শক্ত হয়ে ওঠে। আব্বাও নাছোড়বান্দা। যেভাবেই হোক এই এক গাছা স্বর্ণের পাতা তার চাই। এভাবে করে পানির একদম তলদেশে পৌঁছে যায়। কোনোরকমে শিকড় ছিঁড়তে সক্ষম হয় সে। তাড়াতাড়ি করে উপরে উঠে আসতে চান কারণ অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখনই। যখন তিনি উপরে আসতে গেলেন তখনই মনে হলো কেউ তার মাথা চেপে ধরে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আব্বা ভীষণ ভয় পেয়ে যান। একটা বার নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকেন তিনি। যতোই উপরে ওঠার চেষ্টা করেন ততই আরো ডুবে যেতে থাকেন পানির নিচে। তিনি চিৎকার করে তার দুই ভাইজানকে ডাকতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোভাবেই তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয়না। আব্বা ভেবেছিলেন, ওইদিনই বুঝি তার শেষদিন। হঠাৎ মনে হলো তার কানের কাছে মোটা গলায় কেউ বললো,”এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। ভালো হয়ে যা।”
আব্বার আর কিছু মনে নেই। পরের দিন তার যখন জ্ঞান ফেরে তিনি নিজেকে দাদীর খাটে দেখতে পান। তার চারপাশে দাদী,চাচারা, মেজো চাচী, আম্মা সবাই কাঁদছে। আব্বার মাথায় কিছু আসছে না, কীভাবে সে এখানে এলো? উঠে বসার চেষ্টা করতেই আব্বা দেখলেন তার শরীর অতিশয় দূর্বল। দাদী আব্বার হাত চেপে ধরলেন।
আব্বা ফিসফিস করে বললেন,”আম্মা আমি এখানে কেনো?”
দাদী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,”আব্বাজান তোরে ভোরবেলা তোর বড় ভাইজান ওযু করার সময় পুকুরঘাটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। কি হয়েছিলো তোর?”
আব্বা কোনো কথা বলতে পারেন না। দাদীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। এরপর সবার কাছ থেকে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন তার কৃতকর্মের জন্য। দিনের পর দিন আব্বা একজন সম্পূর্ণ অন্য মানুষে পরিণত হতে থাকেন। সেই ঘটনার পর থেকে আব্বা সব ধরণের খারাপ সঙ্গ বাদ দেন। এক ওয়াক্তও নামাজ কাজা করেন না। আম্মাকেও রাজরানী করে রাখেন তার মনের মধ্যে।
তাই এই পুকুরের ইতিহাস আসলে আমাদের কাছে নতুন না। দাদীর কথা শুনে আব্বা মাথা নিচু করে ফেলেন। দাদী বলেন,”সময় কম আশরাফ। এখনই বেরিয়ে পড়ো। একটা ঘরও যেনো বাদ না পড়ে।”
আব্বা ফজরের নামাজ পড়েই বেরিয়ে গেলেন। বড়দা যেতে চেয়েছিলো আব্বার সাথে, কিন্তু দাদী বললেন তাকে দিয়ে অন্য কাজ আছে। আম্মা আর মেজো চাচীকে দাদী বললেন,”ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে। এরপর মেয়ের হলুদের ব্যবস্থা করতে। আর প্রতিবেশী মেয়ে বউদের ডেকে এনে তাদের সাথে মশলা কুটে ফেলতে।
মেজো চাচা দোতলার বারান্দায় বসে ছিলেন। দাদী তার পাশে এসে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
“আম্মা কিছু বলবেন?”
“এভাবে বসে থাকলে হবে? সেজানকে নিয়ে হাটে যাও। বাজার সদাই করতে হবে। গরু কিনতে হবে। এছাড়াও আমাদের হিন্দু গ্রামবাসীদের জন্য খাসি কিনতে হবে। বাবুর্চিদের ডাকতে হবে। রায়হান জেলে ডেকে এনে পুকুরে বড়শি ফেলবে। নষ্ট করার মতো সময় নেই হারুন।”
“আম্মা, আমার কথা শোনেন। ভাইজান একটা কথা বললো জ্বরের ঘোরে আর আপনিও সাথে সাথে সব আয়োজন শুরু করতেছেন। পাত্রপক্ষ জানাক যে তারা রাজি, আপনার উঠোনে গরু খাসি ভরে যাবে, দুশ্চিন্তা করেন না। কিন্তু এভাবে অনিশ্চয়তার পরে সব আয়োজন করে আমি লোকের কাছে উপহাসের পাত্র হতে পারবো না। আমার ঘরেও মেয়ে আছে। তার বিয়ের কথাও আমার ভাবতে হবে আম্মা।”
দাদী চোখ লাল করে মেজো চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন,”হারুন, তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছো এখনো সরদার বাড়ির অভিভাবক তুমি হওনি। আমি বেঁচে আছি এখনো। এ বাড়ির মানসম্মানের কথা আমাকে ভাবতে দাও।তোমাকে যা বলছি তাই করো।”
মেজো চাচা রাগে গজগজ করতে করতে মেজদাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমাকে আর মেজো আপাকে দাদী বড় আপাকে কাঁচা হলুদ বাটা দিয়ে গোসল করিয়ে আনতে বললেন। আমার ছোট ভাই রাজের বয়স আট বছর। সে দৌড়ে এসে দাদীকে বললো,”দাদী আমাকে কোনো কাজ দিলেন না?”
দাদী মুখ টিপে হেসে রাজের থুতনি চেপে বললেন,”তুমি তোমার বড়দাকে সাহায্য করো। সে পুকুরে মাছ ধরতে গেছে।”
কাজ পেয়ে রাজ খুব খুশি। দৌড়ে চলে গেলো সে। বড় চাচা একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গেলে দাদী বলেন,”কি ব্যাপার কালাম কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“আম্মা গঞ্জে দোকানে যাচ্ছি। রূপালীর জন্য কাপড় কিনতে হবে। এ ছাড়াও বাড়ির অন্য মেয়ে বউ, নতুন কুটুমদের জন্য কাপড় আনতে হবে।”
“তোমার যেতে হবে না। তোমার শরীর দূর্বল। কর্মচারীদের খবর পাঠাও। তারা দোকানের সেরা কাপড় দিয়ে যাবে বাড়ি।”
“তাই বললে কি হয় আম্মা? নিজের মেয়ের বিয়ে।”
দাদী চুপ করে থাকলেন। বড় চাচা এসে দাদীর হাত ধরে বললেন,”আম্মা একা আপনিই আমাকে বিশ্বাস করলেন। বাকি সবাই অবিশ্বাসের সাথেই কাজ করছে। গতকালের ঘটনা আপনাকে বলবো আমি।”
দাদী বড় চাচার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,” সব পরে শুনবো। আমি জানি তুমি ভুল করার মতো মানুষ নও। আমার বিশ্বাস আছে তোমার উপর। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”
সকাল এগারোটা বাজতে না বাজতেই আমাদের উঠোনে গরু, খাসি,মুরগি ভরে গেলো। বড়দা জেলেদের সাহায্যে পুকুর থেকে বিশাল বিশাল মাছ তুলছে। গঞ্জ থেকে নতুন কাপড় এসেছে সবার। বড় আপাকে কাঁচা হলুদ দিয়ে গোসল করিয়ে হলুদ শাড়ি পরিয়ে দিয়েছি আমরা। একটা পুতুলের মতো লাগছে ওকে। গ্রামের এক ঝাঁক মেয়ে বউরা এসেছে আম্মা চাচীদের সাহায্য করতে। আমার ফুপুর বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামের মেম্বার বাড়ি। তারাও চলে এসেছে খবর পেয়ে। বাবুর্চি এসে গেছে ইতোমধ্যে। চারদিকে উৎসব উৎসব ব্যাপার। বড় চাচা শুধু বারান্দার এপাশ ওপাশ করছেন দুশ্চিন্তায় কারণ এখনো কোনো খবর আসেনি। দাদী তসবিহ পাঠ করছেন বারান্দায় চেয়ারে বসে। মেজো চাচা বারবার এসে বড় চাচাকে খোঁচা মেরে কিছু বলতে যাচ্ছেন, কিন্তু দাদীর অগ্নিদৃষ্টি দেখে সাহস পাচ্ছেন না।
সবাই যখন দুশ্চিন্তার চরম মুহুর্তে তখন ছেলের বাড়ি থেকে ফোন আসে, ছেলের দাদী ভীষণ অসুস্থ, হয়তো আর বাঁচবেন না। মৃত্যুর আগে তিনি নাতবৌ এর মুখ দেখতে চান। তাই ছেলের পরিবার চাচ্ছে আজই ছোট করে অনুষ্ঠান করে কলমা পড়িয়ে ফেলতে। কোনোরকম আয়োজনের প্রয়োজন নেই। পরে তারা বড় করে অনুষ্ঠান করবে।
ফোন ছেড়েই বড় চাচা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন দাদীকে জড়িয়ে,দাদীও কাঁদেন সাথে। বড় আপা আমাদের দুইবোনকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। সে এক মধুর দৃশ্য।
পাত্রপক্ষ সন্ধ্যার ঠিক আগে চলে এলো। রান্নাবান্না তখন প্রায় শেষ। কিন্তু বিয়ের পড়ানোর ঠিক মিনিট খানিক আগে আবার সেই ঝড়, প্রলয়। জানালার কপাট জোরে জোরে বাড়ি খাচ্ছে। যেনো কেউ তার প্রচন্ড রাগ ঝাড়ছে আমাদের উপর। বড় চাচা ভয়ে দাদীর কাছে গেলেন। দাদী বললেন,”কিচ্ছু হবে না কালাম। আল্লাহকে ডাকো।”
এরপর আমাদের সবাইকে বললেন,”রূপালীকে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সবাই ঘিরে বসে থাকো। ও যেনো কোথাও না যায় ঘর ছেড়ে। রায়হান,সেজান,রাজ তোরা বড় আপাকে জাপ্টে বসে থাক।”
বড়দা বললো,”কিন্তু কেনো দাদী?”
“বেশি কথা বলিস না। জানালা দরজা আটকে রাখ। মেজ বৌমা, ছোট বৌমা তোমাদের উপর ওর ভার থাকলো।”
সেই প্রলয়ের মধ্যেই এশার আজানের ঠিক দশ মিনিট পর বড় আপার বিয়ে হয়ে যায়। দাদী কোনোভাবেই দেরি করতে রাজি নন। অদ্ভুত ব্যাপার! বিয়ে পড়ানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় তুফান থেমে যায়। শেষবারের মতো ধড়াম করে হলঘরের জানালা বাড়ি খেয়ে থেমে যায়। আমরা কেঁপে উঠি সেই শব্দে। বড় চাচা আমার আব্বা আর বড়দাকে বলেন একচল্লিশ কেজি মিষ্টি পুকুর পাড়ে রেখে আসতে। আব্বা কোনো প্রশ্ন না করে বড়দাকে নিয়ে বেরিয়ে যান মিষ্টি নিয়ে।
পরের দিন বড় আপাকে নিয়ে তারা চলে গেলো। সাথে গেলো মেজো আপা। আমারও যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমার মনে পড়ে আছে বড় চাচার সেদিনের ঘটনা শোনার জন্য। এখন কোথাও যেয়ে আমি শান্তি পাবো না। তাই শরীর অসুস্থতার বাহানা দিয়ে আমি বাড়িতে থেকে গেলাম।
বড় চাচার সারাদিন মন খারাপ থাকলো। থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। মা মরা মেয়েকে কোনোদিন চোখের আড়াল করেন নি বড় চাচা। ছোট থেকে একদম মাথায় তুলে রেখেছেন। সেই মেয়েকে এই প্রথম চোখের আড়ালে পাঠিয়ে তার মন ভালো নেই। মন ভালো নেই আমাদের বাড়ির কারো। বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতো বড় বাড়ির পুরোটা জুড়েই কি তবে আপা ছিলো? আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো।
সন্ধ্যায় মাগরীবের নামাজের পর বড় চাচা সবাইকে দাদীর ঘরে ডাকলেন আমি আর রাজ বাদে। আমরা যদি ভয় পাই কিছু নিয়ে। কিন্তু আমি গো ধরে বসে থাকলাম। আমি শুনবোই। পরে বড় চাচা বললেন, ঠিক আছে পালকীও থাকুক।
“সেদিন ঝড়ের রাতে আমি কাঁপতে কাঁপতে পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু পুকুরপাড়টা ছিলো একদম সুনসান, নীরব। আমি ফাঁকা স্থানেই জোরে জোরে সালাম দিলাম। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আমার মনটা কেমন খচখচ করতে থাকে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর চলে আসবো এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন আমাকে সালাম দিলো। কণ্ঠ শুনে হাত পা জমে এলো আমার ঠান্ডায়। আমি সালামের উত্তর দিয়ে পিছনে ঘুরে তাকালাম। কিন্তু কেউ নেই, শুধু পুকুরপাড়টা আলোয় ঝলমল করছিলো। কোথা থেকে কথা ভেসে আসছে তবে? আমি একমনে আয়াতুল কুরসি পড়ছি। গায়েবী আওয়াজে ভেসে এলো,”কালাম, তোর মেয়ের বিয়ে হবে কাল এই পাত্রের সাথে। যা ব্যবস্থা কর।”
আমি তো চমকে উঠেছি শুনে। আমার শরীর জুড়ে কাঁপুনি উঠেছে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। নড়ার ক্ষমতাও যেনো নেই। আবার গায়েবী আওয়াজ ভেসে এলো,”বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মেয়েকে একা কোথাও যেতে দিবি না, একা যেনো না থাকে। আর চুল খোলা রেখে যেনো কখনো ছাদে না যায়। একটা খারাপ জ্বীনের আছড় পড়েছিলো তোর মেয়ের উপর। যে চায়না তোর মেয়ের বিয়ে হোক। সে এতোদিন তোর মেয়ের বিয়ে বন্ধ করে রেখেছিলো।”
আমি কোনোরকমে ভয়ে ভয়ে বলি,”তবে সে এখন কোথায়?”
“তা নিয়ে তোর ভাবার দরকার নেই। মনে রাখবি এই বাড়িতে আমি কোনো সমস্যা হতে দেবো না ইনশাআল্লাহ। যা তুই এখন। বাড়ি যেয়ে সবাইকে খুশির খবর দে। আর কুলসুম জাহানকে আমার সালাম দিস।”
তারপর আমি তাকে সালাম জানিয়ে ফিরে আসি।”
এতোক্ষণ বড় চাচা সেদিনের সন ঘটনা বলছিলেন। আমরা বুঁদ হয়ে বসে সব শুনছিলাম। দাদীর ঠোঁটে হাসি। মেজো চাচা মুখ গোমড়া করে আছেন। আমার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে আছে। আমি ছুটে যেয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরি।
দিনগুলো ভালোই চলছিলো আমাদের। কিন্তু এর মধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যা আমাদের জীবনটাকে এক মুহুর্তে ওলট পালট করে দিলো।ঘটনার দিন বাড়িতে শুধু দাদী, আমি আর রাজ ছিলাম। সবার দাওয়াত পাশের গ্রামে আমার ফুপুর বাড়ি। আমি যাই নি কারণ আমার মাইগ্রেনের ব্যথা ভীষণ বেড়েছে আর রাজের সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। আম্মা কোনো ভাবেই দুই ছেলেমেয়েকে রেখে যাবেন না। দাদী বললেন,”ছোট বৌমা তুমি অনেকদিন কোথাও যাও না। আমি আছি রাজ পালকির সাথে। তুমি সবার সাথে যেয়ে ঘুরে এসো।”
আম্মা তাও খুঁতখুঁত করছিলেন, কিন্তু দাদী জোর করে আম্মাকে পাঠিয়ে দিলেন সবার সাথে।
দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর দাদী একটু ঘুমান। দাদীর ঘরে তিনি ঘুমাচ্ছেন আর রাজ তার ঘরে বসে পড়ছে। আমিও ভাবলাম একটু ঘুমাবো। কেবলই বিছানা তৈরি করছি। এরমধ্যে আমার মেজদা মানে মেজো চাচার ছেলে সেজান আমার ঘরে প্রবেশ করে। তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠি। ওর চোখ টকটকে লাল। কেমন নিয়ন্ত্রণহীনের মতো লাগছে ওকে।
তোতলাতে তোতলাতে বলি,”কি রে মেজদা? তুই যাস নি? কোথায় ছিলি তুই?”
হুট করে মেজদা আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো ভিতর থেকে। আমার বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। বিছানা থেকে এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলাম,”কি ব্যাপার? কি করছিস তুই? দরজা আটকে দিলি কেনো?”
ফোঁস করে উঠলো মেজদা। চোখ লাল করে বললো,”আজকের কথা কাউকে বলবি না তুই।”
ওর মুখ থেকে ভকভক করে বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমি নাকে ওড়না চেপে বললাম,”তুই নেশা করেছিস মেজদা?”
হঠাৎ ও আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দেয়। আমি চিৎকার করে ডাকি,”দাদী দাদী, রাজ রাজ।”
খিকখিক করে বিশ্রী করে হাসে মেজদা।
“কাদের ডাকছিস? আমি ওদের ঘরে বাইরে থেকে আটকে দিয়ে এসেছি। এই সরদার বাড়িতে কেউ নেই আজ তোকে বাঁচানোর।”
আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। আমি পাগলের মতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি। কেমন অচেনা লাগছে ওকে আমার। ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি। নিজের বোনের মতো আগলে রেখেছে সবসময় বড়দা,মেজদা। এ কি রূপ দেখছি আজ তার? আমি প্রাণপনে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ…..
(চলবে)
[আমার সম্মানিত পাঠকের কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি কারণ আমি প্রথম পর্বে বলেছিলাম গল্পটি দুই পর্বের হবে। এই পর্বেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে আমার আরেকটি পর্বের প্রয়োজন হলো। আমার প্রিয় পাঠকেরা কি বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন না?]