#পুকুর রহস্য
পর্ব ৪ ও শেষ
বাড়ির সবাই এতোটাই চমকে উঠলো যে, কারো মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সবাই অবাক হয়ে মেজো চাচার দিকে তাকিয়ে আছে।
দাদী শক্ত গলায় বললেন,”তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে হারুন? কি আবোলতাবোল বকছো পাগলের মতো?”
মেজো চাচা চিৎকার করে বললেন,”আম্মা, এতোদিন আপনি যা বলেছেন আমি সব শুনেছি, কোনোদিন কোনো প্রতিবাদ করিনি। তার মানে এটা নয় যে আপনি কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে আমি তা সহ্য করবো।”
সবাই অবাক হয়ে মেজো চাচার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদীর সামনে এভাবে কথা বলার সাহস এ পর্যন্ত কারো হয়নি। দাদী শান্তস্বরে বললেন,”তুমি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছো যে, সেজানের দুর্ঘটনার পিছনে এই পুকুরই দায়ী?”
মেজো চাচা গলার স্বর আরো বাড়িয়ে বললেন,”এটা একটা বাচ্চাও বুঝবে আম্মা, আপনিও বুঝতে পারছেন। এভাবে নির্মমভাবে জখম করা কোনো মানুষের কাজ হতে পারে? তাছাড়া সেজান আজকে কোথাও যায়নি বাড়ি থেকে, আমাদের সাথে বেরোনোর পর ও বললো যে ওর শরীরটা খারাপ লাগছে, ও বাড়ি যেয়ে বিশ্রাম করবে। তারপর ও সোজা বাড়ি চলে এসেছে। বাড়িতে শুধু আপনি, পালকি আর রাজ। কে এভাবে ওকে নৃশংসভাবে জখম করবে আপনি বলুন।”
আমার ইচ্ছা করলো চিৎকার করে সবাইকে সব সত্য বলে দিতে, কিন্তু অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি, কারণ এখনই সবকিছু বলার সময় নয়।
দাদী উঠে দাঁড়ালেন। আব্বার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আশরাফ সেজানকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করো। চিকিৎসার যেনো কোনোরকম ত্রুটি না হয়।”
মেজো চাচা আবারও চিৎকার করে বললেন,”না আম্মা, আগে আপনি আমাকে কথা দিবেন, কাল থেকেই এই পুকুর ভরাটের কাজ শুরু হবে। তারপর আমি সেজানকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। নাহয় আমার ছেলে এই সরদার বাড়িতেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।”
সবাই আঁৎকে উঠলাম আমরা। মেজো চাচার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? কি বলছেন এসব পাগলের মতো।
“হারুন এখন এসব কথা বলার সময় নয়। আমার বিশ্বাস এই পুকুর আমাদের কারো ক্ষতির কারণ হতে পারে না, যদি না সে কোনো পাপ করে।”
“তবে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার ছেলে কোনো পাপ করেছে?”
“আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না এখন। কালাম, আশরাফ, রায়হান কি দেখছো তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? এক্ষুনি ওকে গাড়িতে ওঠাও।” এরপর মেজো চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন,”কারো কোনো কথা শোনার দরকার নেই।”
এই বলে দাদী দোতলার সিঁড়ির দিকে গেলেন, কারণ উনি এখন নফল নামাজে বসবেন। কোনো বিপদ আপদ আসলেই দাদী বিপদ না কাটা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে থাকেন।
পিছন থেকে মেজো চাচার চিৎকার ভেসে আসছে,”এই পুকুর আমি ভরাট করেই ছাড়বো, দেখি আমাকে কে আটকায়।”
পরের কিছুদিন যে আমাদের কীভাবে চললো সে শুধু আমরাই জানি। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে মেজো চাচা এই বুঝি পুকুর ভরাটের কথা বলেন। আমি মনেপ্রাণে চাচ্ছি চাচা যেনো আর এই কথা মুখে না আনেন। ওদিকে মেজদার অবস্থা নাকি আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। সবাই একবার করে তাকে হাসপাতালে দেখতে গেছে, আমি বাদে। অসুস্থতার বাহানা দিয়ে আমি যাইনি। কারণ আমি চাইনা ওর মুখ দেখতে। তবে শুনেছি জ্ঞান ফেরার পরেও নাকি মেজদা কারো সাথে কথা বলছে না। একদৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে আর প্রতিদিন রাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে। বাকিরাত আর ঘুমায় না। আমি নিশ্চিত মেজদা সেদিন এমন কোনো একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে যা অপার্থিব সেই সাথে অতিপ্রাকৃত। তিনি যে-ই হন তার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে তিনি নিষ্পাপদের কোনো ক্ষতি করবেন না।
এতোদিন মেজো চাচা আমাদের কারো সাথেই তেমন কথা বলেননি। বেশিরভাগ সময়ই তিনি ছেলের কাছে হাসপাতালে থাকতেন,বাড়িতে খুব কমই থাকতেন। আমরা ভেবেছিলাম মেজো চাচা বোধ হয় পুকুর ভরাটের কথা ভুলে গেছেন। তবে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যেদিন মেজদাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হলো। বাড়ির সবাই যখন মেজদাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন আমি আমার ঘরে বসে ছিলাম, আমার ইচ্ছা করছিলো না ওই জানোয়ারের মুখ দেখতে। হঠাৎ আমাদের নিচের হলঘরে কিছুটা চিৎকার চেচামেচি শুনে আমার বুকটা ধক করে ওঠে। মেজো চাচা আর বড় চাচার গলা পাওয়া যাচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে আমার। আমি এক ছুটে নিচে চলে আসি। মেজদা আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। এমন কাজ করিস কেনো যা তোর মাথা উঁচু করতে দেয়না? তবে আমার মনোযোগ এখন ওর দিকে না, আব্বা চাচাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে তা জানা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বড় চাচা সবসময় শান্ত গলায় কথা বলেন৷ তবে আজ তার কণ্ঠ সামান্য উদ্ধত।
“হারুন, আমি তোমার বড় ভাই। আমার কথা তোমাকে অবশ্যই শুনতে হবে। এই পুকুর আমাদের ঐতিহ্য। সবকিছু কি তুমি ভুলে গিয়েছো?”
“দেখুন ভাইজান, বড় বলে এতোদিন অনেক সম্মান করেছি আমি। কিন্তু এই বাড়িটা আমারও। এই বাড়ির ভালোমন্দে আমারও কথা বলার অধিকার আছে।”
“বেশ সেজান তো এখন সুস্থ, ওকে জিজ্ঞেস করো কি হয়েছিলো সেদিন? যদি পুকুর সম্পর্কিত কোনো ঘটনা না হয়, তবে কেনো শুধু শুধু পুকুর ভরাট করবে তুমি?”
বড় চাচার কথা শুনে মেজদা কেঁপে উঠলেন।
মেজো চাচা গলা উঁচু করে বললেন,”আপনিই দেখেন ওর অবস্থা। কথাই বলতে পারছে না ও ভয়ে। আমি আর কোনো কথা শুনবো না। কাল থেকেই আমি পুকুর ভরাটের কাজ হাতে নিবো।আশা করবো আপনারা আর কিছু বলবেন না এ ব্যাপারে।”
বড় চাচা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দাদী চোয়াল শক্ত করে বললেন,”এ বাড়িতে এতোদিন যে কথা ওঠে নি তবে তাই বলতে হবে হারুন। পুকুরে একা তোমার ভাগ নয়, তোমার দুই ভাইয়ের ভাগ রয়েছে। তুমি একা পুকুর ভরাট করতে পারো না।”
মেজো চাচা হাতমুঠ করে বললেন,”বেশ তবে যদি তাই হয়, আমি এই বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিলাম, আমাকে একা ওই পুকুরের ভাগ দিতে হবে। আর যদি তা না হয় আমি এক কাপড়ে আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। আর কারো সাথে কোনো যোগাযোগ থাকবে না আমাদের।”
আমরা চমকে উঠলাম মেজো চাচার কথা শুনে, মেজদাও অসহায়ভাবে তার বাবার দিকে তাকালো। দাদী কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন, আমি যেয়ে তাকে ধরলাম। তার চোখের কোণে পানি।
“আজ পর্যন্ত এই সরদার বাড়িতে যে কথা কেউ ভাবতে পর্যন্ত পারে নি, তুমি আজ তাই বললে হারুন। একই বাড়িতে হাঁড়ি আলাদা হবে আমার তিন ছেলের? এ দিনও আমার দেখার ছিলো?”
বড় চাচা আর আব্বা এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মাথায় একটা জিনিস আসছে না মেজো চাচা এতো পাগল হয়েছেন কেনো পুকুর ভরাট করতে? এটা কি শুধু মেজদার এই দুর্ঘটনার জন্য নাকি আর কোনো কারণ আছে?
বড় চাচা গলা উঁচু করে বললেন,”হারুন আম্মার সামনে এভাবে কথা বলতে পারলে তুমি? এক্ষুনি আম্মার কাছে ক্ষমা চাও, এক্ষুনি।”
মেজো চাচা হলঘর প্রস্থান করতে করতে বললেন,”আগামীকাল লোক আসবে পুকুর ভরাট করতে। দেখি আমাকে কে আটকায়।”
দাদী কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। সবাই যেয়ে আমরা দাদীকে ধরলাম।
“এ কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছে কালাম? তোর আব্বা মৃত্যুর আগে আমার হাত ধরে অনুরোধ করে গিয়েছেন এই পুকুর যেনো আমার দায়িত্বে থাকে, কেউ যেনো কোনো ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু এই সংসার কীভাবে জোড়া লাগাবো আমি?”
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন দাদী। দাদীর কান্না দেখে আমাদের সবার চোখে পানি আসে। আমি এক ছুটে পুকুরপাড়ে চলে আসি। এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো আমার? দীঘির পানির মতো টলটলে স্বচ্ছ পানি। আমি ঘাটলাটায় বসে বসে নিজের চুল চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি আমি।
সে রাতে আব্বা,বড় চাচা,আম্মা সবাই মেজো চাচাকে অনেক বোঝান, এমনকি মেজো চাচীও চাচ্ছিলেন মেজো চাচা যেনো এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। কিন্তু কোনোভাবেই মেজোচাচা কারো কথা শুনলেন না। গ্রামের কেউ সরদার বাড়ির পুকুর ভরাটের মতো সাহস করবে না, তাই মেজো চাচা শহর থেকে লোক খবর দিয়েছেন। আগামীকাল তারা বায়নার টাকা নিতে আসবে, সেরকম হলে আগামীকাল থেকেই পুকুর ভরাটের কাজ শুরু হয়ে যাবে। শেষ রক্ষাটা বুঝি আর হলো না তবে।
বাড়ির সবার মন অসম্ভব খারাপ। কেউ কিচ্ছু খায়নি রাতে। দাদী সেই যে ঘরের দরজা দিয়েছেন এখনো খোলেননি। বড় চাচা, আব্বা অনেক ডেকেছেন, কারো কথা দাদী কানে তোলেননি। আমরা সবাই মনমরা হয়ে পড়ে আছি। নিজের ঘর বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম আমি। ঠিক কতো রাত হয়েছে জানিনা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনে বুঝলাম বেশ রাত হয়েছে। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো কেউ যেনো কাঁদছে, খুব করুণ সুরে। বেশ অপরিচিত লাগছে আমার সুরটা। এভাবে কে কাঁদছে? আস্তে আস্তে সেই আগরবাতির কড়া গন্ধ আসতে থাকে। আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে। ক্রমেই গন্ধ আর কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে।আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। দরজা খুলে বের হয়ে বারান্দায় চলে এলাম। দমটা বন্ধ লাগছে আমার ভিতরে। কিন্তু বাইরে এসে মনে হলো কান্নার শব্দটা খুব আশপাশ থেকেই আসছে। আর তীব্র গন্ধ আগরবাতি আর কর্পূর মেশানো। বেশ অস্বস্তি হতে থাকে আমার। কি মনে করে বারান্দা থেকে পুকুরের দিকে তাকালাম আমি। যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি কোনোদিন প্রস্তুত ছিলাম না। আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো।
অদ্ভুত রকম সাদা একটা জোব্বা পরা বিশালদেহী কেউ পুকুরের দিকে মুখ করে বসে আছে। আমি শুধু তার পেছন দিকটাই দেখতে পাচ্ছি। আর হ্যা তাই তো, কান্নাটা তো ওদিক থেকেই আসছে। কি সেই কান্নার সুর, ভিতরটা এক মুহুর্তে ফালাফালা করে দেয়। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। কে হতে পারে উনি?
আর কিছু মনে নেই আমার। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার, আমি নিজেকে বারান্দাতেই ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করি। তড়িঘড়ি করে উঠে বসি আমি, আমি রাতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? কিন্তু কেনো? আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে যায় আমার গতরাতের কথা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, গুণগুণ করে কান্নার শব্দ, সেই আগরবাতির তীব্র গন্ধ, তারপর বারান্দায় এসে ওই দৃশ্য। ভয়ে আমার বুক কাঁপতে থাকে। ছুটে যেয়ে বারান্দার রেলিঙ ধরে পুকুরের দিকে তাকালাম। দিব্যি টলটলে পানি বুকে এখনো জ্বলজ্বল করছে আমাদের পুকুর। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে কি হতে যাচ্ছে? মেজো চাচা কি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না? আমি সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নিচে চলে আসি। অন্যদিন এখানে সবার কতো আনন্দ, হাসি ঠাট্টা চলতে থাকে। আজ কেমন নীরব। সকালটা এতো মন খারাপের কেনো? আমার বুকে ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়।
মায়ের কাছে গিয়ে শুনলাম মেজো চাচা নাকি অনেক সকালেই বের হয়ে গেছেন গঞ্জে৷ নিজের দোকানে। আজ শহর থেকে পুকুর ভরাট করার লোক আসবে, তাই সকাল সকাল কর্মচারীদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে উনি চলে আসবেন। মেজো চাচীরও মন বেশ খারাপ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কিছু না খেয়েই উপরে উঠে চলে আসলাম। বারান্দায় বসে দুই হাঁটুতে মুখ গুজে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি পুকুরটার দিকে। কতো স্মৃতি আমাদের এই পুকুর জুড়ে। একসাথে সব ভাইবোনের সাঁতার শেখা। শব ই বরাতের রাতগুলোতে আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে পুকুরে ভাসিয়ে দিতাম, কি এক আনন্দ ছিলো আমাদের। এক নিমিষেই সব এমন হয়ে গেলো কেনো? এসব ভাবছিলাম আর চোখের পানি ফেলছিলাম আমি।
“পালকি।”
হঠাৎ কারো ডাক শুনে আমার ধ্যান ভাঙে। চমকে উঠে তাকাতেই দেখি মেজদা। এই নির্লজ্জটা আমার কাছে কি চায়? আমি বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যাচ্ছিলাম।
পিছন থেকে আবার ডাকলো,”তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে রে পালকি।”
আমি ঘুরে তাকালাম।
“তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। শুধু কথা কেনো? তোর মুখের দিকে তাকাতেই ঘেন্না লাগছে আমার। আজ তোর পাপের জন্য সরদার বাড়িতে এমন একটা দুর্যোগ আসতে চলেছে। লজ্জা করে না কথা বলতে? তোর বোনের মতো আমি, আমার সাথে অসভ্যতা করতে এসেছিস, নির্লজ্জ কোথাকার।”
আমি একদলা থুথু মেঝেতে ফেললাম। এতোদিনের রাগ সব উগড়ে দিবো আজকে।
“তোর কপাল ভালো বাড়ির লোককে আমি সব জানাইনি। পুকুর নিয়ে ভীষণ মন খারাপ ছিলো আমার। তাই কাউকে কিছু বলিনি। তবে ভাবিস না সব ভুলে গেছি আমি। তোকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না আমি।”
মেজদা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালো।বড্ড অসহায় লাগছে ওকে। লাগুক, যে অন্যায় ও করেছে কোনোভাবে তার ক্ষমা হয়না।
“পালকি আমি জানি যে অন্যায় আমি করেছি, আমাকে মেরে ফেললেও তার ক্ষমা হয়না। আমি পাপী পালকি। তবে আমি যে শাস্তি পেয়েছি তা যেনো এই দুনিয়ার আর কেউ না পায়। একটা সময়ে আমার মনে হচ্ছিলো এই হিংস্রতা থেকে আমাকে মেরে ফেললেও বোধহয় ভালো হতো।”
আমি কোনো কথা না বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“প্রতিরাতে আমি সেই দৃশ্য স্বপ্নে দেখি। আমি চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যাই। সারারাত ঘুমাতে পারিনা আমি।শারিরীক যন্ত্রণার থেকেও মানসিক যন্ত্রণা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে রে পালকি। তুই জানিস আমি কতোরাতে যে একা একা উঠে আত্মহত্যার কথা ভেবেছি। কিন্তু আমি ভীষণ ভীতু, তাই হয়তো পারিনি।”
আমি চমকে উঠে তাকালাম, কি বলছে ও এসব?
“হ্যা রে পালকি, যে যন্ত্রণার মধ্যে আমি আছি এরচেয়ে মৃত্যুই ভালো আমার জন্য। আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। সেদিন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মদ খেয়েছি আমি। তারপর আমার আর নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তুই আমাকে শাস্তি দে পালকি। আমার তো সাহস নেই, আমি হাতে করে বিষ এনেছি। তুই আমাকে বিষ খাইয়ে দে। তবে যদি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।”
মেজদা চাদরের তলা থেকে একটা ছোট্ট শিশিতে কিছু একটা বের করলো। আমি জানিনা কি বলা উচিত আমার। আমি ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক এমন সময় আমার ছোট ভাই রাজ হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আমার কাছে আসলো।
আমি ওকে দেখে বললাম,”কি রে রাজ? এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে?”
“ছোট আপা পুকুরের দিকে তাকাও। দেখো কি হচ্ছে।”
আমরা ছুটে যেয়ে রেলিঙ ধরে নিচের দিকে তাকালাম। কি অদ্ভুত! বড় বড় সমুদ্রতে জলোচ্ছ্বাস উঠলে যেমন বিশাল বিশাক ঢেউ উঠতে থাকে ঠিক তেমন ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের পুকুর পাড়ে। আশেপাশের গাছগুলোকে পর্যন্ত ধরাশায়ী করে ফেলছে সেই ঢেউ। আমরা দৌড়ে নিচে চলে আসলাম। মেজো চাচা বাদে আমাদের পরিবারের সবাই ওখানে। সবাই জোরে জোরে দোয়া দরুদ পড়ছে। আমি আমার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম ভীষণ ভয় করছে আমার। কি সর্বনাশ হতে চলেছে আমাদের আবার?
দাদী চিৎকার করে বলতে লাগলেন,”এতোদিন এই পুকুরের ভালো দিক দেখেছো। আজ দেখবা অন্যরূপ। আমাদের কাউকে ছাড় দেবে না। শেষ করে দেবে আমাদের, তছনছ করে দেবে সবকিছু। কাউকে রেহাই দেবে না, কাউকে না।”
দাদীর কথা শুনে ভীষণ ভয় করতে লাগলো আমার। সবাই চিৎকার করে কাঁদছি ঠিক এই মুহুর্তে খবর এলো গঞ্জে আমার মেজো চাচার সাতটা দোকানে ভয়াবহভাবে আগুন লেগেছে, কোনোভাবেই আগুন থামছে না। আমরা যেনো অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলাম। দাদী সাথে সাথে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমরা ধরাধরি করে দাদীকে ঘরে আনলাম। দাদীর জ্ঞান না ফেরা দেখে বড় চাচা যেতে পারছেন না। তাই আগেই আব্বা আর বড়দা বেরিয়ে গেলেন। মেজদাও যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু ওদিকে মেজো চাচীর কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা ভালো না। পুরো বাড়িতে এক শোকের আগুন জ্বলতে থাকলো।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর দাদীর জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরেই দাদী শোয়া থেকে উঠে বসলেন। বড় চাচাকে বললেন,”কালাম, আমার হারুনকে এক্ষুনি বাড়ি নিয়ে আয়, ওর কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না। দোকান পুড়ে যাক, আমার মানিকরে আমার কাছে নিয়ে আয় কালাম।”
দাদী বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন। বড় চাচা গায়ে পাঞ্জাবি চাপাতে চাপাতে বেরিয়ে গেলেন।
গঞ্জে আমাদের মোট ছাব্বিশ খানা কাপড়ের দোকান। যার একুশটা আমার আব্বা আর চাচাদের আর বাকি পাঁচটা আমার ফুপুর নামে। মেজো চাচার ভাগের সাতটা পূবদিকে। শোনা গেছে সেই সাতটাতেই সন্ত্রাসীরা চাঁদার টাকা না পেয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে সে দোকানগুলোতে। আমরা বাড়ির মধ্যে বসে ছটফট করছি। যেতেও পারছি না আর কোনো খবরও পাচ্ছি না। আমাদের সরদার বাড়ির মেয়ে বউদের হুটহাট বাইরে যাওয়া নিষেধ, ওদিকে বড়দা, আব্বা সবাইকে সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছি কেউ ফোন তুলছে না। হয়তো ফোন তোলার মতো অবস্থায় নেই তারা। কিন্তু আমরা বাড়ির কয়টা মানুষ যে কি হয়ে যাচ্ছি তাতো কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। মেজদা কারো কোনো কথা শুনলো না। অসুস্থ শরীর নিয়ে গায়ে কোনোরকমে একটা শার্ট চাপিয়ে বের হয়ে গেলো। যাওয়ার আগে আমাকে আস্তে করে বলে গেলো,”দোয়া করিস যেনো ওই আগুনে আমি পুড়ে শেষ হয়ে যাই আজকে। যদি মরে যাই আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
এই বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ও। আমি দোরগোড়ায় বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলাম। এতো কষ্ট হচ্ছে আমার, কাউকে দেখাতে পারবো না সে কষ্ট। কেনো আমাদের সাজানো গোছানো সংসারটা এক নিমিষে এমন ছারখার হয়ে গেলো? কার কুনজর পড়েছিলো এই সোনার সংসারের উপর?
দাদী জায়নামাজে ঠায় বসে আছেন, মেজো চাচী প্রায় অজ্ঞান, তার মাথায় পানি দিচ্ছে আম্মা আর মেজো আপা। আমি পাকসাফ হয়ে কুরআন শরীফ পড়ছি। এখনো ওদিক থেকে কোনো খবর আসেনি। কিছুই জানিনা কি হচ্ছে ওদিকে। কেউ ফোন ও দিচ্ছে না আমাদের।
এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্যদিন মাগরীবের পরেই আমাদের বাড়ির শ খানিক লাইট এক নাগাড়ে জ্বলে ওঠে। দূর থেকে মানুষ দেখতে পায় সরদার বাড়ির আলো জ্বলছে। সেই সরদার বাড়ি আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। জ্বলেনি কোনো বাতি। পুকুর এখন তুলনামূলকভাবে কিছুটা শান্ত। আমি আস্তে আস্তে পা টিপে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালাম। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইলাম, পারলাম না, বুকটা ভার হয়ে আসছে ব্যথায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও বুঝি ফুরিয়ে গেছে৷ আমি হাঁটুতে মুখ গুজে বসে থাকলাম শান বাঁধানো ঘাটটায়, আজ একটুও ভয় করছে না আমার অন্ধকারে এখানে একা বসে থাকতে। তাকিয়ে ছিলাম কাকচোখ কালো পুকুরের পানির দিকে। ঠিক এমন সময় সদরদরজার আওয়াজ শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম আমি। ঠিক শুনেছি তো? হ্যা ঠিকই তো। ওরা চলে এসেছে? এক্ষুনি ভিতরে যেয়ে খবর পাঠাতে হবে। আমি এক লাফে বাড়ির মধ্যে চলে গেলাম। হলরুমে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলাম।
“দাদী, আম্মা, মেজো চাচী, মেজো আপা, কে কোথায় আছো? চলে এসো। সবাই চলে এসেছে যে।”
সবাই যেনো অপেক্ষা করেই ছিলো। ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হলো সবাই। দাদী উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। কোনোরকমে এসে দাঁড়িয়েছেন, আমি তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।
পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘর্মাক্ত শরীরে আমাদের বাড়ির পুরুষেরা হলঘরে প্রবেশ করলো। কারো মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সবার শেষে জবুথবু হয়ে প্রবেশ করলেন মেজো চাচা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই একে একে দাদীর পায়ের কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়লো। শুধু মেজো চাচা এখনো অপরাধী মুখে দাদীর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়েছে শোনার সাহস হচ্ছে না কারো ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে।
দাদী আস্তে করে বললেন,”হারুন, বাবা আমার। আমার কাছে এসো।”
মেজো চাচা যেনো এই ডাকটারই অপেক্ষায় ছিলেন। ছুটে এসে দাদীর পায়ে পড়ে গেলেন। এমন ভাবে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকলেন যেনো আমাদের সরদার বাড়িটাই থরথর করে কাঁপতে থাকলো। চাচার কান্না দেখে আমাদের সবার চোখে পানি।
দাদী মেজো চাচার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”কিচ্ছু হয়নি বাবা, কিচ্ছু না। তোমার ভাইদের সম্পত্তি মানেই তোমারও সম্পত্তি। এখন এতো ভেঙে পড়ো না হারুন। আমার সোনা বাবা। কেঁদো না, কেঁদো না।”
ছোট্ট বাচ্চারা কাঁদলে যেমন তাদের মায়েরা তাদের স্বান্তনা দেন সেভাবে আমার দাদী মেজো চাচার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
মেজো চাচা তবুও চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,”আমাকে ক্ষমা করে দেন আম্মা, ক্ষমা করে দেন। আমি অনেক বড় পাপ করেছি আম্মা। আমাকে ক্ষমা করে দেন….”
আরো কি যেনো বলতে থাকলেন,কান্নার শব্দে শোনা গেলো না।
“সন্তানের উপর বাবা মায়ের অভিশাপ থাকে না বাবা। হয়তো রাগ হয় কিছু সময়ের জন্য, তবে অভিশাপ কখনোই দিই নি তোমাকে। তুমি পুকুর ভরাট করতে চাও তো? বেশ করো! যদি তোমার মনে হয় এই পুকুরই সব সর্বনাশের জন্য দায়ী, তবে তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো তাই করো। আমার কিছু বলার নেই।”
পুকুর ভরাটের কথা এতো দুশ্চিন্তায় মনেই ছিলো না আমার। দাদীর কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো আমার। ভয়ে ভয়ে মেজো চাচার দিকে তাকালাম।
মেজো চাচা হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন। দাদীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”আল্লাহ যাকে আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে পাঠিয়েছেন আমি তা নষ্ট করে দিবো আম্মা? অনেক পাপ করেছি আম্মা, আর পাপের ভাগিদার আমাকে হতে বলবেন না আম্মা।”
আমরা ভয়াবহভাবে চমকে মেজো চাচার দিকে তাকাই। কি বললেন এটা তিনি?আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না কি বলছে মেজো চাচা। দাদী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
“তার মানে? কি বলছো হারুন?”
“জ্বি আম্মা ঠিক বলছি।”
“কি ব্যাপার সবাই চুপ করে আছো কেনো? হারুন এসব কি বলছে? আমাকে কেউ বুঝায় বলো তোমরা।”
দাদীর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। তার মুখটা ঝলমল করছে খুশিতে সে বেশ বুঝতে পারছি আমি।
আমি ছুটে যেয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরলাম খুশিতে। কারণ আমাদের মন বলছে পুকুর আর ভরাট হবে না।
আবার দাদীর পায়ের কাছে বসে পড়লেন মেজো চাচা।
“আম্মা গো, আম্মা। আজ আমি নিজের চোখে যা দেখেছি, আমি জীবন দিয়ে হলেও এই পুকুর রক্ষা করবো ইনশাআল্লাহ। আপনাকে কথা দিলাম আমি।”
“কি দেখেছো হারুন?”
মেজো চাচা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলেন। বড় চাচা আর আব্বা এসে তাকে দুইপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলেন।
“আম্মা যখন আমার দোকানগুলোতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে,আমি দিশাহারার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি পানির জন্য। তখনও ভাইজান বা আশরাফ কেউ যেয়ে পৌঁছায়নি। সন্ত্রাস গুলো চারপাশ দিয়ে ঘিরে ছিলো, গ্রামের কেউ এক বালতি পানি নিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিলো না। কষ্টে আমার মনে হচ্ছিলো আমি নিজেই পুড়ে যাই আগুনে। আমার কষ্ট করে বড় করা দোকান, আমার সন্তানের মতো। সেই সন্তানকে চোখের সামনে পুড়তে দেখার কি কষ্ট কেউ বুঝবে না আম্মা। ঠিক তখন, হ্যা ঠিক তখন….”
মেজো চাচা আর কিছু বলতে পারছেন না। শুধু কাঁদছেন।
“কি হয়েছে হারুন তখন?”
“আম্মা এক ঝাঁক সাদা জোব্বা পরা ব্যক্তি, না আম্মা মানুষ না তারা। প্রায় নারিকেল গাছ সমান লম্বা। তারা বড় বড় মঠে করে পানি দিচ্ছেন আমার দোকানে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিলো আমি বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছি শোকে। কারণ সন্ত্রাস গুলো পাশে দাঁড়িয়ে তখনও হাসছে। কিন্তু ঠিক তখনই আমার ভুল ভাঙে যখন দেখি তাদের একেকবার পানির দমকে দোকানের প্রায় এক চতুর্থাংশ করে আগুন নিভে যাচ্ছে। যা দেখে আশেপাশের সবাই অবাক, কি হচ্ছে এসব? ওই জানোয়ার গুলো পর্যন্ত হা করে তাকিয়ে আছে। কেরোসিন লাগিয়ে আগুন দিয়েছে আম্মা তারা, এতো সহজে আগুন নেভার তো কথা না। আমি পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলাম আম্মা। আমার সারাজীবনের দম্ভ,জিদ সাথে সাথে মাটিতে মিশে যেতে লাগলো আম্মা গো। আমি পাগলের মতো চিৎকার করছিলাম তখন খুশিতে। ঠিক তখনই তাদের মধ্যকার বিশালদেহী জোব্বা পরা একজন হঠাৎ নিমিষেই আগুনের দলাতে পরিণত হলো, যা সোজা ধেয়ে গেলো ওই জানোয়ার গুলোর দিকে, ওরা ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে উল্টোদিকে দৌড় লাগিয়েছে। আমার দোকানের আগুন তখন প্রায় শেষের দিকে। ঠিক তখন আশরাফ আর রায়হান সেখানে উপস্থিত হয়। আমি ওদের দেখে সাথে সাথে জ্ঞান হারাই।”
আব্বা বলেন,”আম্মা জানেন, মেজো ভাইজানের দোকানের যেরকম ক্ষতি হওয়ার কথা ছিলো তার দশ ভাগও হয়নি। কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছেই তবে সেই তুলনায় কিছুইনা।”
আমাদের যেনো সহ্য করার ক্ষমতাও আর নেই। আমি মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। সবাই তাই।
বড় চাচা চোখের পানি মুছে বলেন,”ঠিক ওই সময়টাতেই আমাদের পুকুরের পানি বিশাল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছিলো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করেছেন আম্মা, আমাদের রক্ষাকবচ দিয়ে।”
দাদী আর কোনো কথা বললেন না। আলুথালু শাড়ির আঁচল কোনোরকমে মাথায় চাপিয়ে সোজা চললেন পুকুরঘাটে, তার পিছু পিছু আমরাও ছুটলাম। আজ আমাদের বাড়ির সবাই আমরা পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছি।
দাদী চিৎকার করে বললেন,”এই কে আছিস? সব বাতি জ্বালিয়ে দে সরদার বাড়ির। আজ আমরা আনন্দ করবো, আজ আমাদের আনন্দের দিন।”
বড়দা,মেজদা আর রাজ যেয়ে সব আলো জ্বালিয়ে দিলো। ঝলমল করে উঠলো সরদার বাড়ি আবার।
বড় চাচা দাদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন,”আম্মা অনেকদিন আমাদের গোসল করায় দেন না আপনি। আগে মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের চার ভাইবোনকে আপনি কেমন পুকুরে এনে সাবান ডলে ডলে গোসল করিয়ে দিতেন। আজ বড্ড শখ করছে আম্মা।”
দাদী বড় চাচার কান মলে দিয়ে বললেন,”আমার বুড়ো ছেলের শখ দেখো না।”
আব্বা আর মেজো চাচাও তখন আম্মাকে ধরে দাঁড়িয়েছেন, তাদের আবদার আজ তাদের আম্মার তাদের ছোটবেলার মতো গোসল করিয়ে দিতে হবে পুকুরে। দাদী সন্তর্পণে চোখ মুছলেন। এরপর আম্মা আর মেজো চাচীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”দেখো তো এদের কাণ্ড। আর পারিনা বুড়ো ছেলেদের নিয়ে। যাও তো বৌমা আমার তোলা নতুন শাড়িটা এনে দাও।”
সবাই একসাথে হৈহৈ করে উঠলাম আমরা।
আম্মা আর মেজো চাচী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমরা সবাই ঝপঝপ করে পানিতে নেমে পড়লাম। রাত তখন বাজে প্রায় দশটা। আমাদের আনন্দ উৎযাপনের যে এতো বিকট শব্দ, পুরো সরদার বাড়ি গমগম করতে লাগলো। হঠাৎ পুকুরের পানিও কেমন ছলকে উঠলো, ঠিক যেনো সে ও আমাদের সাথে আনন্দ উৎযাপন করছে। এক ঝাঁক ভিন্ন বয়সী তিন প্রজন্মের আনন্দরত মানুষগুলোকে বুকে নিয়ে যেনো গর্বে মেতে উঠলো আমাদের সরদার বাড়ির পুকুর।
(সমাপ্ত)
[এখানেই শেষ হলো আমার পুকুর রহস্য গল্পটি। পুরো গল্পজুড়ে আমার যে সম্মানিত পাঠক/পাঠিকারা আমাকে নিরন্তর অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কেউ কেউ হয়তো দুই পর্বের জায়গায় চার পর্ব হওয়াতে রাগ হয়েছিলেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ। আপনাদের পছন্দ হলে আবারও এমন কোনো গল্প নিয়ে আসবো। সবাই অনেক অনেক ভালো থাকবেন।]
দ্যা ব্লাক বুক গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/black/
পিশাচ দেবী গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/pichas-uponas/
রুম নাম্বার ৯০৯