# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -১৬
আরিয়ার স্টাডি রুমে দাঁড়িয়ে আছে রোজা। চারপাশে বইয়ের বাহার। সারি সারি বইয়ের মাঝে কোথায় কোনো প্রমাণ খুঁজে পাবে রোজা? কথাটা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোজা। লাইব্রেরির এককোণা থেকে অদম্য মনোবল নিয়ে ব্যতিক্রম কিছু খুঁজতে লাগলো সে। ১৪ বছর আগের কোনো ঘটনার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন কিন্তু পারতে তো তাকে হবেই। একে একে প্রতিটি তাকেই চোখ বুলালো রোজা। ড্রয়ার, টেবিল, চেয়ার এমনকি ময়লার ঝুড়িও বাদ দিলো না। কিন্তু ফলাফল শূন্য! ভাঙা মন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। দরজায় তালা লাগিয়ে আরিয়ার বেডরুমের দিকে তাকালো । এই রুমটা প্রথমদিনই খুঁজে দেখেছে সে তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে এখানেই কিছু আছে। রোজা আবারও তালা খুলে রুমটাতে ঢুকলো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লাগালো সে। সেদিন সব জায়গায় চেক করেছে, বাকি রয়ে গেছে আসবাবপত্রের তলাগুলো। এগুলোর নিচে কিছু লুকিয়ে নেই তো? রোজা অনেক খুঁজে দরজার পাশে ঝুল ঝাড়ার লম্বা একটা ঝাড়ুর দেখা পেলো। মোবাইলের লাইট আর ঝাড়ুর সাহায্যে বিছানা, সোফা, টেবিল সবকিছুর নিচে চেক করে নিলো সে। কিন্তু আবারও হতাশ হতে হলো তাকে। একঝাঁক হতাশা নিয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। নিচে বসে মাথাটা ফ্লোরের কাছাকাছি নিয়ে লাইট ধরতেই নিচ থেকে কালো রঙের একটা টিকটিক বেরিয়ে এলো। হঠাৎ করে বেরিয়ে আসায় চমকে চেঁচিয়ে পিছিয়ে গেলো রোজা। তাড়াতাড়ি নিজের মুখ চেপে ধরলো সে। টিকটিক দেখে এমন ভয় পেয়েছিলো ভেবে নিজেকে খানিকক্ষণ বকে নিলো সে। বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারও আলমারির নিচে ঝুঁকে পড়লো সে। ধুলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না তার। হতাশ হয়ে উঠে যেতে নিতেই আলমারির এককোণে একটা কাগজ চোখে পড়লো। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া হলুদ রঙের কাগজ। ঝাঁড়ুর পেছনটা দিয়ে অনেক কষ্টে কাগজটা বের করে আনলো সে। ঝাড়ুটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে একহাতে ফোনের লাইট ধরে অন্যহাতে কাগজটা মেললো সে। হলুদ রঙের অনেক আগের কাগজ এটা। জেল কালি দিয়ে লেখা হয়েছিলো বলে অনেক দিনের ব্যবধানে লেখাগুলো একদম ল্যাপ্টে গেছে। রোজা কাগজটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই বুঝতে পারলো এটা একটা চিঠি! রোজা তাড়াতাড়ি তীর্থকে অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে বললো। চিঠিটা ভালো করে পরীক্ষা না করে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারবে না তারা। এটাই হতে পারে তাদের সেই বহু প্রতীক্ষিত সূত্র! তীর্থকে বের হতে বলে রোজাও নিচে নেমে এলো দ্রুত। কাজের লোকেরা যে যার রুমে ঘুমিয়ে আছে। এভাবেই চলে গেলে ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরে যাবে ভেবে সোহেলকে ফোন করলো রোজা। দু’নার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো সোহেল।ফোনটা ধরেই বলে উঠলো,
— কে বলছেন?
— আমি এলিনা সরকার। মৃন্ময় স্যারের বাড়িতে হোম ম্যানেজমেন্টের কাজ করছি।
রোজার কথায় বিরক্ত হলো সোহেল। এই মেয়েটা সবসময় বেশি কথা বলে। ওকে কোনো প্রশ্ন জিগ্যেস করার সুযোগই দেয় না। মাঝে মাঝে মেয়েটার কানের নিচে চড় মারতে ইচ্ছে করে তার কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে না সে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো সে,
— কেনো ফোন দিয়েছেন মিস. এলিনা সরকার?
— এখন ৫ টা বাজে। আমার ডিউটি আছে আর একঘন্টা। আমি এই একঘন্টা আগে কি বাড়ি যেতে পারি? আজকের কাজের রিপোর্ট আমি আপনাকে ই-মেইল করে দিই প্লিজ?
— কেনো? আপনাকে কি টাকা কম দেওয়া হচ্ছে যে কাজ কম করবেন? ডিউটি আওয়ার শেষ না হলে নো বাড়ি যাওয়া। চুপচাপ কাজ করুন।
সোহেলের কথাটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো রোজার। হাতের কাছে একটা ডাব আর সোহেলের মাথাটা পেলে এই ডাব দিয়েই সোহেলের মাথা ফাটিয়ে দিতো রোজা। অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে উঠলো রোজা,
— ওকে? তাহলে মিষ্টার মৃন্ময়কে কল করি। কল করে বলবো আপনি আমার সাথে বাজে টাইপের মিসবিহেভ করেছেন। শুনেছি আপনার স্যার নাকি মেয়েদের সাথে বাজে ব্যবহার একদম সহ্য করেন না। তাছাড়া সাক্ষী দেওয়ার জন্য তো রহীম চাচা আছেই। আপনি বরং ফোনটা রাখুন…(ভাব নিয়ে)
— এই এই? আপনি তো দেখি বড় মাপের মিথ্যেবাদী৷ মিথ্যে বলে আমাকে ফাঁসাতে চান।
— হোয়াটএভার! আপনি ফোন রাখেন তো।
রোজার কথায় ভয় পেয়ে গেলো সোহেল। সাথে প্রচন্ডরকম রেগেও গেলো সে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে উঠলো সে,
— আচ্ছা ঠিক আছে। যান আপনার ছুটি। ফাজিল মেয়ে।
— কি বললেন?
— কিছু না ম্যাডাম। শুধু বললাম, আপনার ছুটি।
— গুড!
কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিয়েই ব্যাগটা নিয়ে দৌড় লাগালো রোজা। উত্তেজনায় রক্ত যেনো টগবগ করছে তার। এবার বুঝি সিঁড়ির নেক্সট ধাপটা পেয়েই যাবে তারা। উফফ, কি আনন্দ।
সন্ধ্যা ৬ টা। রোজাদের অফিস রুমে কপাল কুঁচকে বসে আছে রাদিব,রোজা আর তীর্থ। তিনজনের দৃষ্টিই টেবিলে রাখা চিঠিটির দিকে।
রাদিব চিঠিটিতে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
— কাজটা তোমাদের দুজনকে দেওয়া হয়েছিলো রোজা। তাহলে এখন আমাকে ঘাটানো হচ্ছে কেন?
রোজা অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকালো। আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
— বাবা? আমরা তোমাকে মোটেও ঘাটাচ্ছি না। কাজটি আমরা দু’জনেই করবো। আমরা শুধু জানতে চাচ্ছি আমরা ঠিক পথে এগুচ্ছি? নাকি না? একটি চিঠির উপর বেস করে আমরা কোনো ভারি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না বাবা। তুমি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ। এটুকু সহযোগীতা তো আমাদের প্রাপ্যই। আমরা না হয়ে অন্যকেউ হলেও এটুকু হেল্প তো তুমি করতেই, তাই নয় কি? এজ ইউজাল, তুমি একজন হেল্পফুল পার্সন বাবা।
রাদিব মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মানুষকে কথায় ভুলিয়ে দেবার বিদ্যা তো ওকে শেখায় নি রাদিব তবু এতোটা পটু হলো কিভাবে মেয়েটা? কথাটা ভেবেই নিজের মনে খানিক হাসলো রাদিব। মুখে গাম্ভীর্য নিয়ে বলে উঠলো,
— বেশ! আমি তোমাদের হেল্প করছি কিন্তু ততটুকুই যতটা একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তার সামনের মানুষগুলোর জন্য করে থাকে।
রাদিবের কথায় ঝটপট মাথা নাড়লো ওরা। রাদিব মুচকি হেসে বললো,
— তোমরা যেহেতু একটা ক্লু পেয়েছো, ক্লুটাকে ভালো করে পরীক্ষা কর। চিঠির প্রতিটি লাইনে আরিয়া ঠিক কি কি ব্যক্ত করতে চেয়েছে বোঝার চেষ্টা কর।ওর চিঠির মূলভাবটা বোঝার চেষ্টা করো। এন্ড ভেরি ইম্পোর্টেন্ট থিং, চিঠির ভেতরের ডিরেকশনটা খুঁজে বের করো।
রাদিবের কথায় বিস্মিত হলো তীর্থ। বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
— চিঠির ডিরেকশন?
— ইয়েস মাই সান! চিঠির ডিরেকশন। প্রতিটি চিঠিতেই একটা সুপ্ত ডিরেকশন থাকে।যেমন ধর, একজন ব্যর্থ প্রেমিকের চিঠি আর একজন ভালোবাসায় সিক্ত প্রেমিকের চিঠি কি একরকম হবে? তাদের চিঠি পড়ে কি তোমার একরকম ফিল আসবে?
রাদিবের কথায় ভ্রু কুঁচকালো রোজা। মাথা দুলিয়ে বলে উঠলো,
— একরকম ফিল কি করে আসতে পারে? দুটো মানুষের সিচুয়েশন সম্পূর্ণ আলাদা।
— এক্সেক্টলি মাই ডিয়ার। সিচুয়েশন! আমিও তোমাদের ঠিক এই বিষয়টিই বোঝাতে চাচ্ছিলাম। প্রতিটি চিঠিতেই মানুষ নিজের মনের অজান্তেই তার সিচুয়েশনটা তুলে ধরে। ডিরেক্টলি তুলে না ধরলেও কিছু কিছু লাইনে তা ইনডিরেক্টলিও প্রকাশ পেয়ে যায়। এখন তোমাদের কাজ হলো চিঠির পেছনে আরিয়ার চাপা সিচুয়েশনটা উপলব্ধি করা। একটা চিঠি কখনোই তদন্তের মূল বিষয় হতে পারে না। চিঠিটা এমনিই লেখা হতে পারে যা হয়তো কেইসের কোনো কাজেই লাগবে না। আমার ধারনা মতে তোমাদের মৃন্ময়ের রুমটা চেক করা উচিত। স্পেশাল কিছু পেলেও পেতে পারো। তাছাড়া সব রুম তো চেক করা শেষই। এবার….
মৃন্ময়ের রুমের কথা শুনেই ঢুগ গিললো রোজা।আধো আধো কন্ঠে বললো,
— হি ইজ আ ভেরি ইন্টেলিজেন্ট গাই বাবা। ভেরি ইন্টেলিজেন্ট গাই…
— আই নো। বাট জার্নালিজমে রিস্ক থাকে। রিস্ক তো তোমাদের উঠাতেই হবে। এখনো সময় আছে রোজা ভয় পেলে ছেড়ে দাও।
— নো বাবা। কাজটা আমি করবো। আই শুড প্রোভ মাইসেল্ফ।
আরো কিছুক্ষণ আলোচনা চালিয়ে উঠে গেলো তীর্থ। রোজাও বেরিয়ে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে ডেকে উঠলো রাদিব,
— রোজা? তুমি কি জানো, তোমাকে আমি কতোটা ভালোবাসি?
রোজা ফিরে তাকালো। বাবার হঠাৎ এমন কথায় অবাক হলো সে। বিস্ময় নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। রাদিব চেয়ার থেকে উঠে এসে মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে গভীরভাবে চুমু দিয়ে বলে উঠলো,
— আই ওয়ান্ট আ সাজেশন মাই সুইট প্রিন্সেস।
রোজা বিস্মিত কন্ঠে বললো,
— কি সাজেশন বাবা?
রাদিব রোজার গালে হাত রেখে বললো,
— যদি এমন একটা সময় আসে যখন আমাকে তুমি আর দেশ এই দুটোর মাঝে একটিকে বেছে নিতে হয় তাহলে আমি কাকে বেছে নিবো, মা?
রোজা সাথে সাথেই জবাব দিলো,
— দেশকে বাবা। দেশের প্রতিটি মানুষে এক একটা বাংলাদেশ লুকায়িত বাবা। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসো, নিজের থেকেও বেশি। তুমি যদি শুধু আমায় বেছে নাও তাহলে আমার মাঝে তুমি পুরো দেশকে দেখতে পাবে না বাবা। অথচ, আমায় ছেড়ে দেশটাকে বেছে নিলে পুরো দেশটায় তোমার কাছে আমিময় হয়ে উঠবো। দেশের একটা মানুষের পরবর্তী কখনও আমায় বাঁচিও না বাবা। এতে তুমি নিজের কাছে হেরে যাবে। বরং আমার বদলে দেশের একটা মানুষকে বাঁচিয়ে সার্থক হও বাবা। যাতে আমি সবসময় বুক ফুলিয়ে বলতে পারি “মাই বাবা ইজ সুপারম্যান।” বাবা? আমাকে বেছে নিয়ে হেরে যাওয়ার চেয়ে আমাকে হারিয়ে জেতে যেতে সেকেন্ড অপশনটাই চুজ করো তুমি। কারণ শুধু তুমি নও আমিও এই দেশটাকে প্রচন্ড ভালোবাসি বাবা। আমি সবসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাটাকে দেখতে চাই। এটাই বেশি শান্তির বাবা, ঠিক বলি নি?
রাদিব হাসলো। চোখদুটো টলমল করছে তার। মেয়েটা কিভাবে এতো বড় হয়ে গেলো? এইতো সেদিনও পুরো হাত দিয়েও তার একটা আঙ্গুল আকঁড়ে ধরতে পারতো না মেয়েটি। অথচ, আজ কেমন বড়দের মতো কথা বলছে সে। মুহূর্তেই মেয়েকে বুকে টেনে নিলো রাদিব। ধরা গলায় বললো,
— আই এম সরি, মা! আই এম সো সরি। সব সময় মনে রাখবে, বাবা তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসে। অনেক বেশি!
রোজা হাসলো। সে বুঝতে পারছে কোনো একটা ঝড় আসতে চলেছে তার জীবনে। ভয়ানক ঝড়। সেই ঝড়ে টিকে থাকার ক্ষমতা তার আছে…কিন্তু তার সকল চিন্তা তার ভাইটিকে নিয়ে। ওর কিছু হবে না তো? নিতান্ত বাচ্চা একটা ছেলে ও। কতো স্বপ্ন ওর চোখ জুড়ে। মাত্রই তো নাইন স্টেন্ডার্ডে পা রাখলো সে। রোজা মনে মনে শুধু একটা দোয়ায় করে চলেছে ক্রমাগত….ভাইটা যেন ভালো থাকে তার।
৩০.
বাবার হাত ধরে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বসে আছে আরু। চোখে ভেঙে কান্না আসছে তার। ছোট বেলায় মাকে কাছে পায় নি সে। এই তো বাবা আর ভাইয়া মিলেই সারাদিন আগলে রেখেছে তাকে। কিন্তু আজ! কতোটা একা লাগছে তার। কতোটা নিঃস্ব সে। লিনা প্রেগনেন্ট, বারবার বমি করে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে তার। এদিকে বাবার প্রেশারটাও ফল করছে খুব তারসাথে বুক ব্যাথা। এদিকে ভাইয়াও বাসায় নেই। আরু কি থেকে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আচ্ছা? এবার বাবাকে হারানোর পালা এলো না তো? বাবাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে সে? কিভাবে? এই রাফিন নামক মানুষটা খুব আনলাকি তার জন্য। রাফিনের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই একের পর এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে আরু। জীবনটা এতো অগোছালো কেন? ভুল দিকেই পা বাড়ানোর এতো লোভ জাগে কেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার হাতটা যত্ন করে বিছানায় রেখে পার্স আর প্রেসকিপশনটা নিয়ে বেরিয়ে এলো আরু। ঔষধগুলো এখনই কিনে আনতে হবে তার। ধীর পায়ে হেঁটে রিক্সা নিয়ে ফার্মেসীর উদ্দেশ্য রওনা হলো সে। ঔষধ কিনে ঘুরে দাঁড়াতেই রাস্তার পাশে রাফিনের গাড়িটি চোখে পড়লো আরুর। কিন্তু আজ কোনো রকম আনন্দ দেখা গেলো না তার চোখে-মুখে। মুখের ভাব সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রেখে আগের মতোই হেঁটে যেতে লাগলো সে। রাফিন আরুকে দেখেছিলো। প্রায় তিন-চারদিন পর আরুকে দেখলো সে। কি মনে করে গাড়িটা সাইডে রেখে নেমেও দাঁড়ালো সে। হাতে ফোন নিয়ে স্ক্রল করতে করতে আড়চোখে আরুকেই দেখছিলো সে। চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস হওয়ায় আরুর চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়েনি একদম। মেয়েটা দু’দিনেই খানিকটা শুকিয়ে গিয়েছে। রাফিন অবাক হয়ে খেয়াল করলো আরু আজ ওর দিকে ফিরেও তাকালো না। যেনো রাফিন নামক কোনো ব্যক্তিকে সে চিনেই না। এই নামের কোনো ব্যক্তির হাত জড়িয়ে ধরে কখনো ভালোবাসার কথাও বলে নি সে। এই গালটাতে চড়ও বসায় নি সে। আচ্ছা? মানুষগুলো এতো অদ্ভুত হয় কি করে? সব কিছু এতো সহজে ভুলে যায় কি করে? কই, রাফিন তো পারে না। সে তো প্রতিশোধের নেশায় মত্ত থাকে সবসময়। সবার থেকে প্রতিশোধ নেওয়া বাকি তার….তার চারপাশে এতো প্রতিশোধের খেলা কেন? এই প্রতিশোধের দুনিয়া থেকে কেউকে তাকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনতে পারবে? কারো কি এমন সাহস আছে? কেউ কি রাফিনের চেহারা দেখে গলে না গিয়ে অদম্য সাহস নিয়ে বলতে পারবে….রাফিন খারাপ, ভয়ানক খারাপ? সে এতো ভয়ানক জেনেও ভয় না করে তারদিকে তাকিয়ে সত্যিকারের প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারবে? কই আরু তো পারলো না। রাফিনের খারাপ দিকটা দেখেই মুখ বাঁকালো সে….একটুও তো হাসলো না। তবে কি এমন কেউ নেই? এই দুনিয়ায় সবকিছুই কি তবে মিথ্যে?সব বানোয়াট? রাফিনের চোখদুটো আবারও লাল হয়ে এলো। প্রতিশোধের আগুণ আবারও জ্বলে উঠলো তার মাথায়। আরুকে শেষ করে দেবার দারুন নেশা জাগলো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এবার কি তবে পাল্টে যাবে সবার জীবনের ছক? উলোট পালোট হয়ে যাবে সকলের ভাগ্যরেখা?
৩১.
ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টে বসে আছে তীর্থ আর রোজা। তীর্থের শ্যামলা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ব্ল্যাক টি-শার্টের উপর স্কাই ব্লু চেইক শার্ট পড়েছে সে। হাতে ব্রাউন বেল্টের ব্রেন্ডের ঘড়ি। তীর্থ খুব মনোযোগ দিয়ে বার্গারে কামড় দিলো। খানিকটা চিবিয়ে নিয়ে রোজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— বুঝলি রোজা? আমার না এই মৃন্ময়টাকে ঠিক মানুষ বলে মনে হয় না।
তীর্থের কথায় ভ্রু কুঁচকালো রোজা।
— মানে? মানুষ বলে মনে হয় না তো তাকে ছাগল বলে মনে হয় নাকি তোর?
তীর্থে বার্গারে আরেকটা কামড় দিয়ে কোল্ড ড্রিংকের বোতলটা খালি করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে উঠলো,
— আরে না। সেরকমটা নয়।
— তাহলে? কি বলতে চাস তুই?
— জ্বিন টিন টাইপ কিছু একটা। নয়তো দেখ না…একটা মানুষ এতোটা পার্ফেক্ট কি করে হতে পারে? রাগ নামক জিনিসগুলো একটা মানুষের প্রধান পরিচয় বাট ব্যাটার রাগই নাই। তাহলে কেমন ছাতার মানুষ সে বুঝ একটু। তাছাড়া, আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছিস?
রোজা আবারও ভ্রু কুঁচকালো। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
— কি বিষয়?
— মৃন্ময় বাড়িতে থাকলেও কিন্তু তার উপস্থিতি বোঝা যায় না। না থাকে তার গলার কোনো আওয়াজ আর না থাকে তার কোনো ছায়া। তুইই ভাব…একটা মানুষ কতক্ষণ ঘরবন্দী হয়ে থাকতে পারে? এই ব্যাটায় তো করিডোর পর্যন্তও আসে না। তোর কি মনে হয় না? সামথিং ইজ ফিসি? তাছাড়া সকল ওভার শান্ত মানুষের একটা দানবীয় রূপ থাকে। আপাতত আমি তো তাই বিশ্বাস করি। তুই দেখে নিস, এই ব্যাটা গভীর জলের মাছ। আমার তো একে মানুষই মনে হয় না। অতি ভেজালহীন মানুষের মাঝেই হাঁড়ি ভরা ভেজাল থাকে বুঝলি?
রোজা কিছু বললো না। চুপচাপ কফি কাপে চুমুক দিতে লাগলো সে। কপালটা হালকা কুঁচকে আছে তার। তীর্থের বলা কথাগুলোই মনে মনে আওড়াচ্ছে সে।বার্গারটা শেষ করেই ওঠে দাঁড়ালো তীর্থ। ঘন চুলগুলো পেছনে ঠেলতে ঠেলতে বলে উঠলো,
— চল। চিফ সিকিউরিটি অফিসার আজ ছুটি নিয়েছেন। পারিবারিক সমস্যা আছে নাকি…আমাকে ফুল টাইম দিতে হবে। তাছাড়া মৃন্ময়ের রুমটাও তো সার্চ করবি তুই। আজকে কিছু না পাওয়া গেলে কালকেই রিজাইন করে দু’জনেই কেটে পরবো বুঝলি?
রোজা কিছু বলছে না। ওকে দেখে মনে হচ্ছে তীর্থের কোনো কথায় কানে ঢুকছে না তার। তীর্থ কয়েকবার জোরে জোরে ডাকাতে ধ্যান ভাঙলো রোজার৷ ব্যাগটা হাতে নিয়ে চুপচাপ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো সে। বিল মিটিয়ে তীর্থও দৌঁড়ে গিয়ে ওর পাশে হাঁটা দিলো।
মৃন্ময়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোজা। তীর্থের খবর মতে মৃন্ময় এখনও বাড়ির বাইরে। রোজা চারপাশে একবার চোখ বুলালো। কাজের লোকেরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। রোজার দিকে আপাতত তাকাচ্ছে না কেউ। রোজা দরজাটা একটু আগলা করে ভেতরে ঢুকেই তাড়াহুড়ো করে দরজায় খিল দিলো। বুকে হাত দিয়ে জোড়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে এদিক ওদিক তাকালো সে। কোথা থেকে শুরু করা যায় সার্চিং মিশন? রোজা মৃন্ময়ের আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। হালকা টান দিতেই খুলে গেলো প্রতিটা পার্ট। রোজা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য! আলমারিটা এভাবে খোলা রেখেই চলে গেছে মৃন্ময়? আলমারি ঘেটে মৃন্ময়ের জামা কাপড় ভিন্ন তেমন কিছুই পেলো না রোজা। ড্রয়ার, টেবিল সব জায়গায় চেক করলো সে। আশ্চর্যের বিষয় হলো কোনো ড্রয়ারই তালাবন্ধ নয়। মৃন্ময় কি এতোটাই কেয়ারলেস? নাকি পুরোটাই একটি চাল? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুকসেল্ফের পাশে অসম্ভব সুন্দর একটি ফুলের টব চোখে পড়লো তার। টবটা এমন ভাবে রাখা হয়েছে যেন এখনি পড়ে যাবে ওটা। রোজা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গেলো। টবটায় হাত দিতেই মুখটা হা হয়ে গেলো তার। বুকসেল্ফটা সরে গিয়ে দেয়ালের পেছন থেকে পুরো একটা রুমই চোখে পড়লো তার। কি মারাত্মক! রোজার হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে বারবার। এসবের মানে কি? রোজা ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো রুমের মাঝ বরাবর একটা বড় টেবিল সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজের মাঝে রোজা তার নিজের ছবি দেখে অনেকটায় চমকে গেলো। ছবিগুলোতে এলিনার বেশে রুমের তালা খুলছে রোজা। কি সাংঘাতিক! তবে কি মৃন্ময় সব জানে? কিন্তু কিভাবে? কথা গুলো ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো রোজার৷ সাথে সাথেই বিকট শব্দ কানে এলো তার। চমকে গিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো দেয়ালের আড়ালে ঢাকা দরজাটা অন্য দেয়ালের সাথে মিশে গেছে ইতোমধ্যে। তবে কি ভেতরে ফেঁসে গেলো রোজা? এখন কি হবে তার? নানান দুশ্চিন্তায় মাথাটায় যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। রোজা অসহায় দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতেই মৃন্ময়কে চোখে পড়লো তার। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। গায়ে হোয়াইট টি-শার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। খালি পা। হালকা বাদামী সিল্কি চুলগুলোতে ঢেকে আছে তার কপাল।বাম হাতটা পকেটে ঢুকানো থাকলেও ডান হাতটায় কালো রঙের রিভলবার। চোখদুটো রাগে লাল। রিভলবারটা দেখেই ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো রোজার। তবে কি আজই তার শেষ দিন? জীবনটা এখানেই থমকে যাবে তার?
# চলবে…
(রি-চেক করা হয়নি। প্রচুর ভুল থাকতে পারে। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থী)