রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২২
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
১০.
বাসায় জমজমাট পরিবেশ। ছেলেপক্ষ এলো বলে। মামানি,ফুপি আর আম্মুর কতো শলাপরামর্শ —- “লাখে একটা ছেলে, এই ছেলেকে হাতছাড়া করা চলবে না। কিছুতেই না।” আপু আর রাফিয়া মিথি আপুকে সাজাতে ব্যস্ত। আর আমি? অস্থিরভঙ্গিতে বারবার দরজায় চোখ রাখতে ব্যস্ত। যদি শুভ্র ভাই আসেন! আজ দু-দুটো সপ্তাহ কেটে গেলো কোনো রকম যোগাযোগ করেন নি উনি। কে জানে কেমন আছেন?
আজ তো মামু, মামানি সবাই এসেছে, আজও কি আসবেন না? অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতেই ছেলেপক্ষ এলো। ছেলের মামা, মা,ভাবি আর ছেলে এসেছেন পাত্রী দেখতে। একসময় পাত্রী দেখাও শেষ হলো। সবাই মিষ্টি মুখও করলো। কিন্তু মিষ্টিটা আমার গলা দিয়ে নামলো না। নামবেই বা কিভাবে? গলায় তো আটকে আছে জমে থাকা সব কান্না। সেখানে খাবার প্রবেশের জায়গা কোথায়? দুপুরে খেতে বসার সময় শুভ্র ভাইয়ার কথা মনে পড়লো আম্মুর। মামানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—” ভাবি? শুভ্র কই? ও আসে নি কেন? আজ তো আপনাদের সবারই দাওয়াত ছিলো ভাবি।”
মামানি শক্ত কন্ঠে বললেন,
—“ওর এখানে আসার প্রয়োজন নেই অরি। বাসায় রান্না করে রেখে এসেছি।সমস্যা হবে না।”
আম্মু যেন তেতে উঠলেন৷ রাগটাকে ঢেকে না রেখে খোলা গলায় বললেন,
—“আপনি রান্না করেছেন কিনা সেটা তো আমার দেখার বিষয় নয় ভাবি। ওর ফুপ্পি ওকে খেতে ডেকেছে তারমানে সে এখানে খাবে। নাকি ভাতিজাকে একবেলা খাওয়ানোর অধিকারটুকুও আমার নেই।”
—“তুমি ভুল ভাবছো অরি। তেমন কিছু নয়। আসলে…”
—“আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। রোদ? আমার ফোনটা নিয়ে আয় যা..!”
আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। মনে মনে আম্মুকে হাজারটা ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে গেলাম রুমে। ফোন এনে আম্মুর হাতে দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম উত্তেজনায় হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে আমার। আম্মু ফোনটা নিয়ে শুভ্র ভাইকে ফোন লাগাতেই বলে উঠলেন মামানি,
—“কি দরকার অরি? বাদ দাও না। তুমি জানো কেন আসতে বারণ করেছি আমি। তবুও..”
আম্মু তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,
—” ভাবি? আপনি তো বাচ্চা নন। তাহলে এমন অবুঝের মতো কথা কেন বলছেন? ওটা শুধুই একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আমার শুভ্র এমন কাজ কখনোই ইচ্ছেকৃতভাবে করবে না।”
মামানি কিছু বলবেন তার আগেই ফোন রিসিভ হলো। আম্মু মুচকি হেসে বললেন,
—“ওয়ালাইকুম আসসালাম, বাবা। কই তুই?তোর তো আজ বাসায় আসার কথা ছিলো।”
ওপাশে কি বললো শুনা গেলো না। তবে আম্মু বললেন,
—” শরীর খারাপ লাগলেও আয়। এখানে সবার সাথে থাকলে শরীর খারাপ এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকালাম।আম্মু গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
—“কোনো প্লিজ ফ্লিজ চলবে না। আমি তোর কোনো কথা শুনছি না। দশ মিনিটের মধ্যে তুই বাসায় থাকবি ব্যস।”
আম্মু ফোন কেটে ফোনটা টেবিলে রেখে খাবার সার্ভ করতে লেগে গেলেন। আমি গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। বিছানায় গিয়ে বসতেই রাফিয়া পাশে এসে বসলো। ফোনে চোখ রেখে বললো,
—“রোদু? আমার ক্রাশ কই রে? এমনিতে তো দিনে একবার হলেও বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়। আমি একসপ্তাহ ধরে এসেছি একবারও চোখে পড়লো না।”
আমি অর্ধেকপা বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে রেখেই সটান শুয়ে পড়লাম। দুর্বল গলায় বললাম,
—“জানি না।”
রাফিয়া কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
—“সত্যিই জানিস না?”
আমি উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। রাফিয়ার সাথে বকবক করার নূন্যতম ইচ্ছে আমার নেই। কয়েক মিনিট পর আম্মুর কন্ঠ কানে এলো। তার গলায় খুশি খুশি ভাব,
—” এইতো শুভ্র এসে গেছে। ইশ! চেহারা এমন শুকনো কেন লাগছে? খাস না ঠিকমতো?যা টেবিলে গিয়ে বস।”
আমি ফটাফট চোখটা খুলে দৌড়ে গেলাম দরজায়। দরজার দিকে একপাশ ফিরে বসেছেন উনি। ফরসা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর এলোমেলো চুলেও মারাত্মক লাগছে তাকে। ভালো লাগা জিনিসটাই এমন ঘোর ধরানো। কাউকে একবার ভালো লাগতে শুরু করলে তার সবচে বিশ্রী অভ্যাসটা দেখেও মুগ্ধ হয়ে বলতে হয় —- আহ! কি চমৎকার। কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে ওড়নাটা ঠিক করে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। ইচ্ছে করেই ঠিক উনার সামনের চেয়ারটাতেই গিয়ে বসলাম।
উনি মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে আমি হাজারবার উনার দিকে তাকালেও উনি একটাবারও মাথা তুলে তাকালেন না। পাঁচমিনিটে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন অথচ ফিরেও তাকালেন না। খাবারে পানি ঢেলে রুমে এসে দরজা দিতেই নীরব অশ্রুতে ভরে গেলো আমার চোখ। নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে আমার। উফফ! এতোটা কষ্ট কেন লাগছে?কেন?ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে এলো মুহূর্তেই। চোখের জল মুছে দরজাটা খুলতেই নিভে গেলো সব আশা। মামানি হাসিমুখে বললেন,
—“ভিতরে যেতে দিবি না?”
আমি সরে দাঁড়াতেই আমার হাত ধরে নিয়ে বসালেন খাটে। গালে হাত দিয়ে বললেন,
—“খুব শুকিয়ে গিয়েছিস মা।”
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। উনি আবারও বললেন,
—” মিথির বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস তো? এই উপলক্ষে তোর জামালপুরের ফুপি দাওয়াত করেছে। সাথে আমাদেরকেও করেছে। কাল যাচ্ছি সবাই।”
এটুকু বলে একটু থামলেন। শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,
—“শুভ্রও যাচ্ছে। ওখানে একদিন থাকবে সবাই। ছেলেকে তো একা রেখে যেতে পারি না তাই সাথে নিচ্ছি।”
আমি মুখ তোলে তাকালাম। মামানি নরম গলায় বললেন,
—” শুভ্র থেকে দূরে দূরে থাকিস মা।”
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারও কথা পাড়লেন উনি,
—” শুভ্রর যখন পাঁচ বছর বয়স তখনই একটা মেয়ের খুব শখ হলো আমার। মনে হচ্ছিলো ছেলের সাথে সাথে একটা মেয়ে হলেও কতো ভালো হতো। সাজাতাম, আদর করতাম। জানিস? মেয়েরা একটা বয়সে গিয়ে মায়ের বান্ধবী হয়ে যায়। আমিও চাইতাম আমারও এমন একটা মেয়ে হোক। তার গোপন কিছু দীর্ঘশ্বাসে আমায় সঙ্গী করুক। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বেবি নিতে পারলাম না।
ডাক্তার দেখালাম কিন্তু কোনো সমস্যাও ধরা পড়লো না। তোর মামু একছেলে নিয়েই যথেষ্ট খুশি ছিলেন। তাই বেবি হবে কি হবে না তা নিয়ে তার মাথা ব্যাথাও ছিলো না। কিন্তু কেনো জানি, আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। সিচুয়েশনটা মেনেই নিতে পারছিলাম না। একটা সময় নিজেকে অক্ষম, দুর্বল ভাবতে শুরু করলাম। আর ধীরে ধীরে শুরু হলো ডিপ্রেশন। তার একবছরের মাথায় তুই হলি। আমার অন্ধকার জীবনে রোদ হয়ে। তোর মা হয়তো আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছিলো। তাই তোকে আমার কোলেই তুলে দিয়েছিলো সবার প্রথম। সেদিন মনে হয়েছিল আমি আমার মেয়ে পেয়ে গেছি৷
তোর মা আমাকে এতোটাই অধিকার দিয়েছিলো যে নিজের মেয়ে আর পরের মেয়ে বোধটায় ভুলে গিয়েছিলাম আমি। তোকে আমি মামানি নই মায়ের মতো ভালোবাসি। শুভ্রকে যতোটা ঠিক ততোটাই। তাই হয়তো আমার আদরে তোর আর রুহির মাঝে এতোটা বেশ কম। রুহিকে তুমি করে বললেও তোকে আমার তুই বলতেই ভালো লাগে সবসময়।
তুই যখন একবছরের হলি তখন শুভ্রর সাত বছর। একদিন রুহি,শুভ্র,রাহাত তোকে নিয়ে খেলছে উঠোনে। হঠাৎ করেই তোর কান্নার আওয়াজ কানে এলো। দৌঁড়ে উঠোনে গিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠোন। রক্তের উৎপত্তিটা তোর মাথা। তোর মাথার অনেকটাই কেটে যাওয়ায় এই রক্তক্ষরণ। আর এই আঘাতের কারণ ছিলো শুভ্র। সেদিন ওর হাত থেকেই পড়ে গিয়েছিলি তুই। “
মামানি থামলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও বললেন,
—” এরপর যখন ৪ বছরের বাচ্চা ছিলি তুই তখনও এমন কিছুই ঘটে। খেলতে খেলতে রাগ করে হাতের কাঁচি দিয়ে তোর কচি হাতে ফেঁস দিয়ে দেয় শুভ্র। তোর বামহাতে এখনও একটা কালো দাগ আছে,তাই না?”
আমি মাথা নাড়লাম। ছোটবেলা থেকেই এই কালো দাগটা দেখে আসছি আমি। কিন্তু এই দাগের উৎপত্তির ইতিহাস এতোদিন পর জানতে পারলাম আমি। আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে মামানির চোখের দিকে তাকালাম। তারপর?
মামানি গম্ভীর গলায় বললেন,
—” তুই যখন প্লে তে পড়িস তখনও শুভ্রর জন্য আবারও মাথা ফেটে যায় তোর। আমি ভয় পেয়ে যাই যদি আরো বড় ক্ষতি হয়ে যায় তোর! সেই ভয় থেকেই তোদের আশেপাশে যাওয়া বন্ধ করি আমি। শুভ্রকেও ডুবিয়ে রাখি পড়াশোনায়। ব্যস্ত শুভ্রর মনে তোদের কথাটাও ফিকে হয়ে আসে। শুভ্র যখন থার্ড ইয়ারে উঠে তখন তোর কথা বলি ওকে। “তোকে আমার কাছে আনতে চাই” এই আবদারটাও করে বসি।
ধরে বেঁধে তোদের বাসাতেও আনি। বিশ্বাস কর, আমি ভেবেছিলাম বয়সের সাথে সাথে রাগ বাড়লেও ওর মধ্যে নিজেকে কন্ট্রোল করার এভেলিটি এসেছে কিন্তু সেদিনের ঘটনায় সবটায় ভুল প্রমাণিত হলো। শুভ্র চেঞ্জ হয়নি রোদ। ও আগের মতোই আছে। আমার ছেলে খুব ভালো তা আমি নিজেও জানি কিন্তু ওর রাগকে খুব ভয় পাই আমি রোদ, খুব।শুভ্রকে আমি কতোদিন আটকে রাখবো বল?
আমি জানি ও তোর প্রতি দুর্বল। আমিও শুভ্রর কাছে এটাই চেয়েছিলাম। আর ও আমার চাওয়াটা রেখেছে কিন্তু এখন ও আমার কথা শুনবে না রোদ। এখন তোর প্রতি ওর দুর্বলতাটা এতোটাই বেড়েছে যে আমার চাওয়াটা ও চেষ্টা করলেও মানতে পারবে না। আমি আমার ছেলেকে চিনি রোদ। ও নিজের মনেরটা ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না কিচ্ছু না। তাই তোকেই সাবধান হতে বলছি মা। মামানির কথাটা রাখিস। “
মামানির কথার মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন আম্মু। মামানিকে কি কাজে একরকম টেনেই নিয়ে গেলেন উনি। আমি ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকেই উঠে দাঁড়ালাম। এই ছোট্ট একটা কারণ নিয়ে এতোটা রিয়েক্ট কি মেনে নেওয়া যায়? সেই ছোট্ট বেলা কি না কি হয়েছে তা নিয়ে এতো ভাবনা মামানির? কি অদ্ভুত! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে খুঁজেও শুভ্র ভাইয়ের দেখা মিললো না। সচেতন চোখে প্রতিটা রুম,ছাদ সব চেইক করেও যখন ব্যর্থ হলাম তখনই আদিবাকে ডেকে এনে জিগ্যেস করলাম,
—“আদিবা? তোমার দাদাভাই কোথায়? দেখেছো উনাকে?”
—” দাদাভাই তো খেয়েই চয়ে গেচে। আমি দিকছি।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কে জানে এরপর কি হবে? এমন এলোমেলো ঘটনাগুলোই কি পাল্টে দিবে জীবন? ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলোও মাঝে মাঝে হাজারও দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারো হালকা ভয় কাউকে হারানোর ভয়ে পরিণত হয়। ধাঁধাময় এই জীবনের চারপাশটায় কেমন মায়াময়,কষ্টময়….!!!
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/