কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৫)
ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমেছে। ছাদ থেকে সিমেন্ট খসে পড়লেও ব*জ্রপাত ঘটার শব্দ হবে যেন। খাবার টেবিলে পাঁচজন মানুষ বসে। অথচ কারো একটা টা-টুঁ আওয়াজ মাত্র নেই। তীব্রর খাবার গলবিল পেরোতে চাইছে না। শ্বেত ললাটের শিরাগুলো বড্ড চিহ্ন তুলে চেয়ে আছে। চোখা নাকের পৃষ্ঠ,কোনো ফুঁসে ওঠা নদ। তবে একমনে খেয়ে যাচ্ছে নাহিদ। তীব্রর আকষ্মিক ফেঁপে ওঠা চেহারা দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেও, এখন তেমন চিন্তা হচ্ছে না। ছেলেটা তো এখানে পুষ্পিতার জন্যে ভদ্র সেজে আছে। আর যেখানে ভদ্র সেজে আছে,সেখানকার পাশের বাড়িতে গিয়ে কি ও মা*র*পিট করবে কখনো? না না। এত কসরত করে গোছানো প্ল্যান মাটি করার মতো বোকা তীব্র নয়। তাই আপাতত নিশ্চিন্ত সে। সাথে আয়েশা খাতুনের রান্নার হাত অতুলনীয়। পারলে বিরিয়ানির গোটা হাঁড়িতে ঝাঁ*প দেয় নাহিদ। সে আবার খেতে খেতে তীব্রর দিক ফেরে। সাথে আবার নিশ্চিত হলো তার ভাবনা নিয়ে। এইত, বিট্টু কেমন ভদ্র ছেলের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আশেপাশেও তাকাচ্ছে না। তার মানে ওর ভাবনাই ঠিক!
নাহিদের নজর আচমকা গেল নূহার দিকে। মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে চোরা চোখে তাকাচ্ছে। কী ব্যাপার! কিছু কি বলবে? চোখাচোখি হওয়ায় কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল নূহা। ব্যস্ত ভাবে চাউনী ফেরানোর আগেই, সরল নাহিদ দারুণ হেসে ভ্রু নাঁচাল। যার অর্থ নীরবে শুধায়,
‘’ কিছু বলবেন?”
পুষ্পিতা মেয়ে হিসেবে যতটা নরম? ততোধিক শক্তপোক্ত নূহা। তাকে যেন-তেন ভাবে ভরকে দেয়া মুখের কথা নয়। খুব দ্রুত ক্ষণিকের অপ্রস্তুত ভাব সামলে নিলো সে। নিমিষে সহজ করে ফেলল ছুড়তে থাকা চোরা দৃষ্টি। নিজেও পালটা হেসে মাথা নাড়ল দুপাশে।
বোঝাল,
“ কিছু না।”
নাহিদ আর মাথা ঘামায় না। বুক উথলানো আনন্দ নিয়ে খেতে শুরু করে। নূহার চোখ আবার ঘুরে আসে তার ওপর। যে চোখে মায়ার তটিনী বইছে। হঠাৎ করেই ছেলেটার প্রতি সহমর্মিতা উপচে আসছে ওর। কেন, কী জন্যে,কী কারণ,সেসব জানে না। নূহা কখনো কাউকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসলে অনুভূতি কেমন হয়, তাও জানা নেই। শুধু জানে আজকে নাহিদের অপ্রকাশ্য দুঃখটা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝতে পারছে সে। মনে হচ্ছে এ যেন ওর নিজেরই ব্যথা।
নূহা জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নোয়াল। পুষ্পিতার দিক নজর পড়তেই, আরেকবার চোখ রাঙায় মেয়েটা। অথচ আলগোছে হাসল ও। ছেলেগুলোর কথা তীব্রকে বলে দেয়ায়,গাধীটা বেজায় রেগে গেছে। তাও ভালো। সব সময় এত মিনমিন করে থাকে,একটু-আধটু রাগলেও ভালো লাগে।
আয়েশা খাতুন তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে৷ ভদ্রমহিলা বেশ বিপাকে পড়েছেন। সাথে রাগও হচ্ছে মেয়ের ওপর। তোর কী দরকার ছিল,স্যারের সামনে ফট করে ওসব কথা তোলার? উনি কী মনে করলেন ?
তীব্রর দিক অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও ওর হাবভাবের সিকি আনাও বুঝতে পারলেন না তিনি। একটু যাচাই করতে রয়েসয়ে শুধোলেন,
“ আরেকটু বিরিয়ানি দেই বাবা?”
তীব্র চোখ তুলল। ক্রোধের অনলে টকটকে দুটো চোখ চশমার আড়াল হতে অত ভালো বোঝা যায়নি। তবে কালচে ঠোঁট দুদিক টেনে বলল,
“ না আন্টি।”
স্বাভাবিক স্বর। এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন আয়েশা।
মলিন বদনে হাসি ফুটল তখনই। রাতারাতি কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
“ কিন্তু তুমি তো তেমন কিছুই খেলে না।”
তীব্র ভণিতাহীন জানাল,
“ আমি অয়েলি ফুড কম খাই।”
এরপর আর সাধতে গেলেন না তিনি। নাহিদের থালায় বিরিয়ানি দিলেন। ছেলেটা অমায়িক হেসে আপ্যায়ন গ্রহন করল। কতদিন বাড়ির খাবার খায় না! হোটেলের খাবার খেয়ে জ্বিভটা প*চে গিয়েছিল একদম। এই বিরিয়ানি খেয়ে কী যে ভালো লেগেছে! এখন আগামী এক সপ্তাহ সে আরামসে না খেয়ে থাকতেও পারবে।
নূহা সেই তখনকার সোফায় বসার মতোই তীব্রকে লক্ষ্য করছে আবার। গোটা ব্যাচেলরদের ব্যাপারটা সে ইচ্ছে করে তীব্রর সামনে বলেছে। পুষ্পিতার নামটাও তুলেছে যেচে। এখন শুধু দেখবে, উনি কী করেন! ততক্ষণে খাওয়া শেষ তীব্রর৷ তৎক্ষনাৎ চলে গেল বেসিনে। ট্যাপ ছেড়ে ব্যস্ততা দেখায় হাত ধোয়ার৷ পরপরই ঘাড় কাত করে সেদিকে চাইল,যেদিকের গ্রিল ডিঙিয়ে ঢিল ছোড়া কাগজ এসেছে এখানে। একটা বদ্ধ জানলা ব্যাতীত কিছুই দেখা গেল না। ছেলেগুলো কি ওখানেই থাকে?
তীব্রদের ফ্ল্যাট উল্টোমুখী। চাইলেও সেখান থেকে এই বিল্ডিং দেখার উপায় নেই। সেজন্যেই এতদিন ছেলেগুলো যে কথায়/কাজে নূহাদের জ্বালিয়ে মে*রেছে কিচ্ছু টের পায়নি ও। কিন্তু আজ যখন জেনেইছে,তখন কিছুতেই ছাড় দেবে না। ভিতু মেয়ে শুধু তীব্র রেজা তালুকদারের। তাকে বিরক্ত করার মাসুল,সুদে-আসলে পুষিয়ে নেবে সে।
ট্যাপ বন্ধ করে টেবিলের দিকে ঘুরে তাকায় তীব্র। একদম সোজাসুজি আয়েশাকে জিজ্ঞেস করে,
“ আপনাদের বারান্দাটা সুন্দর! একবার যেতে পারি আন্টি?”
আয়েশা অবাক হলেন৷ ঈষৎ ভাঁজে গুটিয়ে এলো ভ্রু। বারান্দায় তো একটা গাছও নেই৷ সাজানওনি। সুন্দর কোনদিক থেকে হলো? চেহারা ভরতি দোটানা, চেপে রেখে বললেন,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, যাও।”
বলতে দেরি,লম্বা পদযূগল হনহন করে যাত্রা করল সে পথে।
পুষ্পিতা শেষ লোকমা গালে তুলেছে কেবল। এর মাঝেই আয়েশা ফিসফিস করে বললেন,
“ এই পুষ্পিতা স্যারের সাথে সাথে যাও।”
ব্যস! খাওয়ার দফারফা মেয়েটার। সদ্য পেটে ঢালা দানাগুলো এই কথায় আর হজম হতে চাইলো না। মুখখানা চুপসে বলল,
“ ইয়ে মানে আমি?”
“ তো তুমি না আর কে? এসব কি বলতে হয় মেয়ে? স্যার এ বাসায় তো তোমার জন্যেই এসেছেন। তুমি দেখভাল করবে না?”
পুষ্পিতার কী হলো কে জানে! ‘’ স্যার তোমার জন্য এসেছেন” এই কথা শুনেই তার ভেতরটা কুণ্ঠায় আই-ঢাই করে উঠল।
আয়েশা তাগিদ দিলেন,
“ বসে আছো কেন মেয়ে,যাও!”
পরপর অসহায় চোখে নূহার দিকে তাকাল পুষ্পিতা। তার ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। ও ফোস করে দম ফেলে উঠে গেল। ততক্ষণে তীব্র বারান্দায় দাঁড়িয়েছে এসে। অমসৃণ তালুর মুঠোয় রেলিংএর ধার পি*ষে ফেলার চেষ্টা। চিলের নজরে চারপাশ দেখছিল যখন,নরম পাশে পুষ্পিতা পেছনে এসে থামে। মেয়েটা এক পায়ে পায়েল পরেছে। সেই রুনঝুন শব্দ কানে যেতেই,নিবেশিত তীব্রর মনযোগ ঘুরে গেল। তীরস্থ হয়ে দাঁড়াল সহসা। বেঁকে থাকা লম্বাটে দেহটা তৎপর সোজা করে নিলো। কিন্তু পিছু ঘুরল না। পুষ্পিতা শরীরে কোনো সুগন্ধি মাখেনি, অথচ মেয়েলি, মিষ্টি কোনো গন্ধ যেন আপনা-আপনি ছুটে গেল তীব্রর নাসারন্ধ্রে। নেশায় মুদে নিলো সমস্ত ভালো লাগা। প্রসস্থ বুক ফুলিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল সে। একটু আগে রাগে দপদপ করা মস্তিষ্কে হঠাৎই যেন শান্ত বৃষ্টি নেমেছে। তেমনি শান্ত কণ্ঠে বলল,
“এদিকে এসো।”
আচমকা আদেশে মেয়েটা কী করবে ভেবে পায় না। মরুময় স্থানের মতো কাঠফাটা গলবিলে,ঢোক গিলে আরেকটু এগিয়ে দাঁড়াল। তীব্র ফিরে চাইল তখন। বিলাতি নয়নের পূর্ণ দৃষ্টি বর্তাল পুষ্পিতার সুরূপা আননে। খুব ফরসা,গোলাকার মুখখানা। চঞ্চল, পুরূ দুটো ভ্রু। তার মধ্যে আবার ভীষণ ক্ষুদ্রকায় একটা টিপ পড়েছে আজ। চোখে পড়তেই, আদল টানটান করল তীব্র।
পুষ্পিতাকে কখনো সাজতে দেখেনি। একটু পরিপাটি করে চুল বাঁধা ছাড়া মেয়েটা কোনো সাজই জানে না বোধ হয়। অথচ একটা ছোট্টো টিপেই তার চোখ জুড়িয়ে এলো। সেই ছেলেগুলোর ওপর বহ্নির মতো ফুলতে থাকা কোপ*টুকু আরামসে উবে গেল এক্ষুনি।
এদিকে বুকের ভেতরটা সহ কাঁ*পছে পুষ্পিতার। আবার, আবার সেই একইভাবে চেয়ে আছেন উনি। এই চাউনী এমন সোজাসুজি কোনো নারী হজম করতে পারে?
মেয়েটা চিবুক নামিয়ে নিলো গলায়। থুতনীটাকে বক্ষে মিশিয়ে নিতে চাইল। মিহি কণ্ঠে বলল,
“ কিছু বলবেন স্যার?”
তীব্র কিছু বলে না। নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। যেন দ*ণ্ড দিয়েছে কেউ,
‘তীব্র এই মেয়ের দিকে তোমায় আমরণ চেয়ে থাকতে হবে। চোখ ফেরালেই ফাঁসি!’ উত্তর না পেয়ে পুষ্পিতা আরো অপ্রস্তুত হলো। একদম চোখের সামনে একটা পুরুষ দাঁড়িয়ে, মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকলে কোন মেয়ের সাধ্য আছে স্তম্ভের ন্যায় অটল থাকার? শরীর তার ক্ষয়ে পড়ছে লাজে। সত্তা জুড়ে উশখুশে ভাব।
কী বলবে, কী করবে! ইচ্ছে হলো এই শা*ণিত চাউনীর কবল হতে
ছুটে পালিয়ে যাওয়ার। অথচ বেহায়া পা দুটো যেন আজকেই বরফ খণ্ড বনেছে। আঙ্গুল নাড়ানোর জো অবধি রাখেনি। আনচানে ভাব লুকাতে জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল পুষ্পিতা। এদিক-ওদিক তাকাল। ঘন ঘন পাতা ফেলল চোখে। কানের পাশে চুল বসালো। ঘাম মুছল কপালের। যখন চোখের কোণ তুলে তাকায়, তখনো একইরকম তাকিয়ে তীব্র। ফের সটান কপাল কেমন গুটিয়ে বসেছে তার। তেমন গম্ভীর হয়ে বলল,
“ কী করলে এটা?”
পুষ্পিতা ঘা*বড়ে গেল খানিক। ও তো দাঁড়িয়ে ছিল। এক ফোঁটা নড়েনি অবধি। কী করলো আবার? স্যার আজকে একটু বেশিই খিটমিট করছেন। সেদিন ক্লাসেও এমন করেছেন। ওনার মেজাজের কি মৌসুমী বায়ু চলছে?
নিষ্পাপের মতো শুধাল,
“ জি, কি করলাম?”
তীব্র ফটাফট বলল,
“ কাছে এসো!”
পুষ্পিতার প্রাণটা দেহ টপকে এসে ঝুলে পড়ল গলায়। ঝাঁকুনি উঠল শীর্ণ দেহে। কাঁপন তুলল বুকের সমগ্র কোষ।
হতভম্ব হয়ে বলল,
“জি?”
তীব্র সাবলীল। উদ্বেজনা,উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। ভাবমূর্তি এমন, কোনোরূপ সম্পর্ক ব্যাতীত একটা জোয়ান মেয়েকে কাছে ডাকা, কোনো ব্যাপারই নয় । পুষ্পিতার চাউনীদ্বয়ে বিহ্বলতার ছাপ দেখে এগিয়ে গেল নিজেই।
আকষ্মিক এই নৈকট্যের ভার পুষ্পিতা নিতে পারে না। স্তব্ধ সে পিলারের ন্যায় শক্ত বনে যায়। হতচেতনায় রীতিমতো হেচকি উঠে গেল। তীব্রর অতীব সুন্দর মুখবিবরে লেপটে রইল প্রকট দুটো নেত্র। তীব্রর লম্বা দেহ ঝুঁকে আসতে দেখেই, ভয়ে-লজ্জায়-দিশা খুইয়ে কামিচ খামচে ধরল পুষ্পিতা। তীব্রর চোখদুটো একদম তার কপাল বরাবর থেমেছে। দুটো বিপরীতমুখী উষ্ণ শ্বাসের টক্করে যখন পুষ্পিতার নিজেরই দম থিতিয়ে আসতে নিলো,
ঠিক সেই সময়, এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটাল তীব্র। ঠান্ডা হাতটা তুলে ওর বেঁকে থাকা কপালের টিপটাকে সোজা করে বসিয়ে দিলো ফের। তখন ঘাম মুছতে গিয়ে ঘষা লেগে সরে গেছিল। পুষ্পিতা মূর্তি বনে থাকে। শরীর পুরোদস্তুর জমে যায়। সদ্য তোলা হেচকিটাও বন্ধ এখন। তীব্র সরে আসে,ঠিকঠাক হয়। দর্প নিয়ে আওড়ায়,
“ আকাশের চাঁদের গায়ে দাগ মানায়। কিন্তু মাটির এই চাঁদের গায়ে দাগ তো দূর,একটা এঁকেবেঁকে থাকা টিপকেও বরদাস্ত করব না আমি।”
বলেই বেরিয়ে গেল সে। পুষ্পিতা শুনেছে কী না কে জানে! রুদ্ধ নিঃশ্বাসটা ছাড়ল কেবল। ভীষণ গতিতে মাথা ঘুরছে ওর। স্বপ্ন ঠেকছে সব। কিন্তু কেমন স্বপ্ন এটা?
***
পুরো কামরায় পায়চারি করছে তীব্র। থুতনীতে আঙুল ঘষে ঘষে হাঁটছে দু মাথা। সামনের ডিভানে নিষ্পাপের ন্যায় বসে আছে নাহিদ। তীব্রর হাবভাব নিয়ে এখন সন্দেহ লাগছে ওর। কালবৈশাখী আসার আগে সব যেমন থমথমে হয়ে থাকে? তীব্রর এই চুপ করে হাঁটাচলাও তেমন লাগছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কিছুই বুঝতে পারে না বেচারা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাই। একটু পরীক্ষা নিতে শুধাল,
“ তুই কি এখন ওই ছেলে গুলোকেও মা*রবি না কি?”
তীব্র থেমে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ তোর এমন মনে হলো কেন?”
নাহিদের কণ্ঠে বিভ্রান্তি,
“ না মানে এমনই তো করিস৷ তাই আর কী..”
তীব্র ঠোঁট কামড়াল। একটু চুপ থেকে প্রশ্ন ছুড়ল আচমকা,
“ আমি কে?”
থতমত খেল নাহিদ। এ আবার কেমন ধারার প্রশ্ন? জবাব দিলো বোকার মতো,
“ কেন মানুষ! “
তীব্র দাঁত পেষে,
“ তুই আসলেই একটা ঢেঁড়স। আই মিন,এখানে আমি কে?”
নাহিদ মাথা চুলকাল। একটু ভাবতে গিয়ে ভোলাভালা মুখটা ঝলকে উঠল আলোর মতোন। বলল,
“ তীব্র রেজা তালুকদার।”
তীব্র প্রসন্ন চিত্তে এসে পাশে বসল ওর। কাঁধ চাপড়ে বলল,
“ গুড। আমার সাথে থেকে থেকে উন্নতি হচ্ছে তোর।”
নাহিদ অস্বীকার করল না। মাথা দোলাল স্বায়ের মতোন।
তীব্র নিজেই বলল,
“ আমি এখানে শিক্ষক৷ একজন শিক্ষক কি কখনো মা*রপিট করতে পারে? নেভার!
তাই আমিও মা*রব না ওদের।”
নাহিদ ভেতর ভেতর খুশি হয়ে গেল। যাক,তাহলে ও ভুল ভাবেনি। প্রথমবার নিজের আন্দাজ নিয়ে গর্ব হলো তার। তীব্রর ওষ্ঠে তখন রহস্য হাসি। নাহিদের খটকাটা আবার জেগে ওঠে। কণ্ঠ সন্দিহান,
“ তোর পুষ্পিতাকে কিছু ছেলে-পেলে বিরক্ত করছে। এটা জেনেও তুই কিছু করবি না? আদৌ সত্যি বলছিস তো?”
তীব্রর বক্র হাসি বাড়ল।
“ লেকচারার তীব্র তালুকদার মা*রবে না বলেছি। কিন্তু অন্য কেউ তো মা*রতেই পারে।”
নাহিদ কৌতূহলে হাবুডুবু খেয়ে বলল,
“ অন্য কেউ মা*রবে? কে?”
তীব্র পিঠ লাগিয়ে রাখে ডিভানে। একটা পায়ের ওপর আরেক পা তুলে দেয়। বড্ড দম্ভ নিয়ে জানায়,
“ বিট্টু মাস্তান!”
নাহিদ এমন কিছু আশা করেনি। শরীর ছেড়ে দিলো হতাশায়। বুক ফুড়ে ফুস ফুস করে বেরিয়ে এলো দম। যে আশায় উজ্জ্বল দৃষ্টিতে চেয়েছিল, দপ করে নিভে যায় তা। বিট্টু মারুক আর তীব্র,হাত তো একটাই। তাও আবার লোহার মতো শক্ত হাত। এই হাতের একটা থা*প্পড়ই যথেষ্ট। যাকে বলে এক ছো*বলে ছবি!
বিছানার কোল ঘেঁষে, একটা খোলা জানলা দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে ফুরফুরে হাওয়া আসছে কক্ষে। ঘরের মধ্যে জ্যোৎস্নার টিমটিমে আলোর, হালকা ছটা পড়ছে। পুষ্পিতা দেয়ালে পিঠ মিশিয়ে বসে আছে মেঝেতে। দুটো মৃগনয়ন নিশ্চল দূরাকাশের চাঁদের বুকে লেপটে। অন্যমনস্ক চোখের পর্দায় কেবল দুপুরের ঘটনা ভাসছে। সোফায় তীব্রর হুট করে কাছে আসা। বারান্দায় হঠাৎ তর্জন,
“ কাছে এসো।”
ঝুঁকে এসে টিপ ঠিক করে দেওয়া,এসব ভেবে আরেকবার ওর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। নীরব লাজে হাসফাস করে চোখ খিচে নেয় ও। নূহা তখন চুপচাপ ভঙ্গিতে পাশে এসে বসল। পুষ্পিতার ভাবমূর্তি দেখেই,দুষ্টুমি করে বলল,
“ স্যারের কথা ভাবছিস?”
মেয়েটা চমকে তাকায়। নূহা ভ্রু তুলে বলে,
“ ওরে বাবা! এ তো সাংঘাতিক ধ্যানে ছিলি। ডিস্টার্ব করলাম?”
পুষ্পিতা চ সূচক শব্দ করল।
“ কী যে বলিস তুই!”
নূহা বলল,
“ আচ্ছা,বারান্দায় যাওয়ার পর তোর স্যার কী বললেন তোকে?”
“ কিছু না। কী বলবে?”
“ কিছু বলেনি? কিছু করেওনি?”
পুষ্পিতা আশ্চর্য বনে বলল,
“ কী করবে?”
“ কেন, চু*মুটুমু দেয়নি?”
পুষ্পিতা মুখ হাঁ করে ফেলল। পরপরই রাগ দেখিয়ে বলল,
“ এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে নূহা। আমি কিন্তু ভয়ানক রেগে যাব।”
নূহা কাঁধ উঁচাল,
“ তো যা না। রাগতে বারণ করেছি আমি? তোর রাগের দৌড় আমার জানা আছে। ওতে আমি কেন,একটা মুরগীও ভয় পাবে না।”
পুষ্পিতা ঠোঁট উল্টাল। কণ্ঠে নেমে এলো আগের মতো। বলল,
“ তুই তখন ওনাকে অত কিছু কেন বলতে গেলি বলতো! ওই ছেলে গুলো কি আমার নাম নিয়ে বিরক্ত করছিল? করছিল তো আমাদের দুজনকেই। স্যারকে এসব শোনানোর প্রয়োজন ছিল কোনো?”
নূহা তৎপর ওর মাথায় একটা চ*ড় মে*রে বলল,
“ চুপ কর গাধী! আমি যে ওসব কেন বলেছি, সেটা বুঝলে তোকে এমন গাধী বলে ডাকব কী করে?”
বৃহৎ চোখ ঔৎস্যুকে ছোট করল পুষ্পিতা। নূহা বাবু হয়ে বসে। শ্যামরঙা মুখখানা হাসিহাসি করে জানায়,
“ আমি না ওই ব্যাপারটা ইচ্ছে করে তুলেছি বুঝলি! কারণ আম্মু যে ঘরের ব্যাপার ভেবে এসব এড়িয়ে যেতেন, আমার থেকে ভালো কে জানে!
আর কেন ইচ্ছে করে তুলেছি বল তো?”
পুষ্পিতা অনাগ্রহী শুনতে। যদি বলে, কেন? নূহাটা স্যারকে নিয়ে আবার উল্টোপাল্টা বলবে। ওসব ও আর শুনতে চায় না। অবজ্ঞা দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো তাই। কিন্তু নূহা শুনিয়েই ছাড়বে। চিবুক ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো আবার৷ বলল,
“ শোন,উনি যদি তোকে সত্যিই পছন্দ করেন,তবে আজকের এসব শোনার পর হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। নিশ্চয়ই ওই ছেলেগুলোর কোনো না কোনো ব্যবস্থা নেবেন। কাল-পরশুর মধ্যে যদি শুনি ওই জা*নোয়ার গুলোর কিছু একটু হয়েছে,তবেই আমি সব বুঝে যাব।”
পুষ্পিতা ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল। জানতো এসবই শুনতে হবে। নিষ্পৃহ বলল,
“ আচ্ছা যদি উনি পছন্দ করেনও,তাহলে কী হবে?”
নূহার ঝরঝরে গলায় ফুলকে ওঠা আনন্দ। বলল,
“ কী হবে জানিস না? আমি আজকে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি, যদি কাউকে দুলাভাই বানাতেই হয়, তবে তীব্র স্যারকেই বানাব। তোদের দুজনকে পাশাপাশি এত ভালো মানায় না। উফ!”
সহসা বক্ষঃস্থল ছ্যাৎ করে লাফিয়ে ওঠে পুষ্পিতার। অজান্তে,অজ্ঞাত ভাবে ফেঁপে উঠল ফরসা কপোল। তাতে হুড়মুড় করে ছড়িয়ে পড়ল লালচে আভা। তার মুখবিবরের পরিবর্তন নূহা স্পষ্ট চোখে দেখে নেয়। ভ্রু নাঁচিয়ে শুধায়,
“ কী? বুক ধুকপুক করছে?”
পুষ্পিতা ঠোঁট মেলল মিথ্যে বলতে। অস্বীকার করতে এই নিপুণ সত্যি কথা। অথচ জ্বিভ ফস্কে বেরিয়ে এলো,
“ করছে”
নিজের কাজে নিজেই তাজ্জব হয় মেয়েটা। নূহা যুদ্ধে জেতার মতো উত্তেজনায় তালি বাজাল হাতে। অথচ এই আওয়াজ অবধি কানে যায়নি তার। এ কেমন অপ্রতিরোধ্য ভ্রমে ডুবল আজ?
***
রাত তিনটা! চার তলা দালানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তীব্র৷ আশপাশে তার বাজপাখির মতো সতর্ক নজর। জোনাকি পোকার ঈষৎ আলোয় সাদাটে মণি যেন জ্বলজ্বলে প্রদীপ। তীব্র থুত্নীর মাস্ক টেনে নাকে তোলে। আঁটোসাটো বাধন। মাথায় ক্যাপ, হাতে গ্লাভস পরে পেছন ঘুরে দেখল একবার। লম্বা হকি*স্টিকটাকে পিঠের ব্যাগে ত*লোয়ারের মতো খাড়া করে ঢোকানো৷ তারপর খুব সাবধানে টপকে এলো পাঁচিল। পুষ্পিতারা চারতলায় থাকে। কাগজ ছুড়ে মেরেছে যেহেতু, ওরাও নিশ্চয়ই চারতলাতেই থাকবে। তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘরের বন্ধ জানলা দেখে, এটুকু ঠাওর করেছে তীব্র। সেই ভিত্তিতেই আজকে পাশের বাড়িতে হানা দিয়েছে সে। ভাগ্যবশত, এই বিল্ডিংয়ের চার তলায় মোট দুটো ফ্ল্যাট। যেটার পেছন দিকটা পুষ্পিতাদের ঘরমুখী,তীব্র ভেবেচিন্তে সেটার বেলই টিপল। দরজার ওপাশ হতে নিরন্তর হাসি,আড্ডা আর কথার আওয়াজ আসছে। এর মানে মাদা** বাচ্চারা একটাও ঘুমায়নি। স্রেফ একবার দরজা খুলুক, আজন্মের জন্য ঘুম ঘুচিয়ে দেবে আজ।
তীব্র আরেকবার বেল টিপল। ওপাশ হতে কেউ চেঁচিয়ে শুধায়,
“ কে?”
মাস্ক পরুয়া তীব্র কণ্ঠ ঠেসে বলল,
“ আমি। দরজা খুলুন স্যার।”
ওরা কিছু বুঝেছে কী না কে জানে! দোরের নিকট পায়ের শব্দ পেতেই মেরুদণ্ড সচেতন করে দাঁড়ায় সে। সাংঘাতিক দাঙ্গার প্রস্তুতি সাজায় মনের ভেতর। হকিস্টিকটাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে হাতে। দরজার ছিটকিনি টানা হয় প্রথমে। এরপর ঘোরানো হয় লক। যেই মুহুর্তে পুরো দরজা খুলে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত মানুষটির বুকের ওপর শক্তপোক্ত একটা লা*থি বসাল তীব্র। মানুষটি উড়ো পাতার মতো ছিটকে গেল দূরে। ওমনি বাকীরা তাস রেখে তটস্থ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু বোঝার আগেই ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল তীব্র। স্টিক উঁচিয়ে প্রকান্ড প্রহারের প্রস্তুতি নিলো ঠিকই,আহত ব্যক্তির ওপর নজর যেতেই থমকে গেল অচিরে। স্তব্ধতায় আলাদা হয় ঠোঁট । কণ্ঠ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে,
“ শাফিন!”
চলবে…