বিয়ের রাতেই আমি দেখেছিলাম ভোরবেলা আমার স্বামী তার ভাবীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে লুকিয়ে লুকিয়ে।
ঘরে ঢুকেই সে বেরিয়ে যায় গোসল করতে।
পরদিন সকালে তার ভাবী আমার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে তার মেয়ের ভবিষ্যৎের কথা বলল।
চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো আমার বিয়েতে রাজি হওয়াটা ভুল ছিল।বিয়েতে রাজি না হলে সে তার বিধবা ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করে তার ভাইয়ের মেয়েকে নিজের পরিচয় দিতে পারতো।
সেদিন আমি বসে ছিলাম শূন্য হাতে।
কারণ আমিও তখন বিবাহিত।
তারপর? এতগুলো দিন এই বাড়িতে কীভাবে আমি টিকে আছি, নিজের সংসার করছি এই কথা আপনারা কোনো দিন চিন্তা করেন নি।করেছেন শুধু তাদের কথা।
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ইখুম মুখে আঁচল গুজে কথা গুলো বলে কেঁদে ফেলল।তার চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। ইখুমকে ধমকে দিয়ে তার বড় জা বলল,
“হচ্ছে কী ছোটো?বাড়িতে এত মানুষ। এখন এসব বলার কথা?”
“আর এক ঘর লোকের সামনে আমায় বাপ-মা তুলে গালি দেওয়াটা?”
“তোর স্বামী বয়সে বড়।স্ত্রীর প্রতি তার অধিকার থাকেই।”
“কই ভাইজান তো আপনাকে এত লোকের সামনে কোনো দিন গালি দেয়নি।”
“কারণ তোর অভ্যেস মুখে মুখে তর্ক করা। যা আমার না।তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগা।দেখ বাইরে ব্যাটা ছেলেরা বসে আছে। তাদের কাছে নাস্তা ঠান্ডা করে দিবি না কি?আয় বোন আয়।”
কিছুক্ষণ পূর্বে ইখুমের স্বামী বাড়ির মেয়েদের জন্য শাড়ি কিনে এনেছিল।যে শাড়িটা তার পছন্দ হয়েছে সেই শাড়িটা তার মেঝ জায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাই ইখুম বলেছিল তার শাড়ি লাগবে না।তার জন্য রাখা শাড়িটা তার মেঝ জায়ের হাতে তুলে দিতেই রাশেদ তেড়ে আসে তাকে থাপ্পড় দিতে। লাগেনি যে এমন নয়। কানে লেগেছে।কেউ রাশেদকে কিছু বলেনি। সবাই ইখুমের দোষটাই ধরেছে।
ইখুম কোনো জবাব দেয় না।হঠাৎ তার মনে হয় তার মাথার ভিতর শব্দ হচ্ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে টিনের ঘরের চালায় বৃষ্টির ফোটা পড়লে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ।বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর চারিপাশ তবুও থামার নাম নেই।ইখুম পাত্তা দেয় না সেই বৃষ্টির শব্দকে। ইদানীং সে অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে জানে।
ইখুম নাস্তা নিয়ে চলে যাওয়ার পর বাড়ির মেঝ বউ ঢুকলো রান্নাঘরে। সামিনা এই বাড়ির মেঝ বৌ।বছর সাতেক পূর্বে বিয়ে হয় তার এই বাড়ির মেঝ ছেলে কায়সারের সাথে। বিয়ের ৩২ দিনের মাথায় বিদেশ চলে যায় কায়সার।বছর দুই পর দেশে ফিরে তখন পেটে আসে তার মেয়ে স্নেহা।কিন্তু কপালে সুখ ক্ষণচারী। কায়সার বিদেশে দূর্ঘটনায় মারা গেছেন আজ প্রায় চার বছর।
সামিনা রান্নাঘরে ঢুকে দ্রুত কাজে হাত লাগাচ্ছে। তাকে দেখে তার বড় জা বলল,
“স্নেহারে দুধ খাইতে দিস নাই কেন?”
“প্রতিদিন দুধ খাইতে চায় না তো।তাই আজ দেইনি।”
“স্নেহা দুধ খেতে চায় না?তুই বলবি বলে?যে মেয়েটার দুধ এত পছন্দের সে খাইতে চায় না?
দেখ মেঝ স্নেহা আমাদের মেয়ে। তুই কেন নিজেদের ঝামেলায় বাচ্চাটাকে টানছিস?”
সামিনা কোনো জবাব দেয় না।বেরিয়ে যাচ্ছিলো রান্নাঘর থেকে।তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রাশেদ।স্নেহাকে কোলে নিয়ে। রাশেদ এই বাড়ির ছোটো ছেলে।রাশেদকে দেখে সামিনা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।বড় ভাবীর থেকে এক গ্লাস দুধ এনে নিজ হাতে স্নেহাকে খাইয়ে দিচ্ছে রাশেদ।
(২)
এই বাড়িতে যদি সাগরিকা কাউকে দেখে চুপ থাকে সেটা হলো তাশদীদ। শুধু সাগরিকা নয় এবাড়ির সকল বাচ্চারা তাশদীদকে দেখে ভয় পায়। সাগরিকার চার চাচা এক সাথেই থাকেন।তাদের যৌথ পরিবার। যৌথ পবিরাবের বড় চাচার বড় ঘরের ছেলে হচ্ছে তাশদীদ।বড় মা তার মা নয়।তার মা মারা গেছেন তাকে জন্ম দেওয়ার সময়। বড় মায়ের পেট থেকে হয়েছে তাজবিদ। দুই ভাই দুই মেরুর মানুষ।একজন বাবার সাথে ব্যবসা দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিয়েছে। অন্যজন লেখাপড়া করছে।আর সাগরিকা হচ্ছে সেঝ ভাইয়ের মেয়ে।
অনেক গুলো আন্ডাবাচ্চার গল্প বলে কথা। ধীরেধীরে সবার গল্পই আসবে তবে আজ শুরু হোক গল্পের স্পন্দন সাগরিকা। বড় চাচার বয়সের সাথে তার ছোটো চাচার বয়সের অনেক তফাৎ।বড় মা বলেছিলেন বিয়ের সময় বড় চাচার বয়স যথেষ্ট থাকলেও ছোটো চাচা রাশেদের বয়স ছিল মাত্র সাত।তাই তাশদীদ এবং রাশেদের বয়সের খুব একটা তফাৎ বুঝতে পারা যায় না।তাদের দেখে মনে হয় চাচা-ভাতিজা নয় দুই ভাই।
সাগরিকার এই বাড়িতে একটা নাম আছে। নামটা হলো অটোপাশ।
অটো, টেম্পু সহ অনেক নামের তাকে ডাকা হয়ে থাকে। তবুও রাগটা হজম করে নিচ্ছে সে। এ বছর অটোপাশ দেওয়ার কারণে তাকে যতটা ব্যঙ্গ করা হয়েছে ততটা যদি সে ডায়েরি তে লিখতো তবে উপন্যাস হয়ে যেত।
তুলি,সম্পর্কে সাগরিকার ফুপাতো বোন সে জোড়ে জোড়ে গান গাইছে
“আকাশ ছুয়েছে মাটিকে
তুমি ছুয়েছো আমায়,
প্রজাপতি ছুয়েছে ফুল
আমি ছুয়েছি তোমায়
সাগরিকা বেঁচে আছি
তোমারি ভালোবাসায়……… “
গানের সুরে শব্দ করে চিঠিটা পড়লো তুলি।কেউ একজন কাগজে লিখে ইট দিয়ে ঢিল মেরেছে। তুলির কাছ থেকে চিঠি নিতে সাগরিকা ছুটতেই ধাক্কা লাগলো তাশদীদের সাথে।
তাশদীদের হাতে থাকা গরম চা পুরোটা পড়ে গেলো সাগরিকার গলার দিকটায়। তবুও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল সে।
তাশদীদ তার দিকে হিমশীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ধমকের সুরে বলল,
“এত নাচতে ইচ্ছা হলে বাজার থেকে নাচনেওয়ালীর পোশাক কিনে এনে দেই?
লেখাপড়া নেই বেয়াদব মেয়ে?থাপড়ে গালের চামড়া ফেলে দিবো।”
সাগরিকা কোনো জবাব না নিয়ে ভাঙা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রান্নাঘরে রাখলো।সামিনা তাকে দেখে এগিয়ে এলেও সে কিছু বলল না।উল্টো তার সাথে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে।তুলির থেকে সব’টা শুনে বড়মা এগিয়ে গেলেন তার ঘরের দিকে।
তাশদীদকে কিছুই বলে না এই বাড়ির কেউ। মা মরা ছেলেকে তিনি আগলে রেখেছেন। তাশদীদ তাকে নিজের মা মনে করে।
সাগরিকা কারো সাথেই কথা বলল না সে রাতে। তাজবিদ ফিরে এসে তাকে ডাকলেও লাভ হলো না।ঘরের দরজার ফাক দিয়ে একটা মলম দিয়ে বলল,
“কুমুদবতী! মলম লাগিয়ে নে। দাগ পড়ে যাবে না হলে।”
কিন্তু গভীর রাতে সাগরিকা অনুভব করল,
“কেউ খুব যত্ন নিয়ে তার গলার ওড়না সরিয়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।”
(৩)
“স্নেহাকে তুমি দুধ খাওয়াতে নিষেধ করেছো?”
রাশেদের তেজের সাথে বলা কথায় ইখুম বলল,
“আমি কেন বলবো?আমার কী দরকার?”
“তবে কেন মেঝ ভাবী তাকে খাওয়ায়নি?”
“ভাবীকে জিজ্ঞেস করো।”
“স্নেহা বাচ্চা একটা মেয়ে। ওর সাথে রেষারেষি না করলে চলে না?”
“আমি না করিনি।”
“তুমি একটু বেশিই করো।এত সন্দেহ বাতিক কেন তুমি?”
“আমাদের নিজের সন্তান চাই রাশেদ।আমার আপনার সন্তান।আমাদের সন্তান।”
এবার রাশেদ এগিয়ে এসে তার সামনাসামনি বসে বলল,
“আমার মনে হয় তোমার কয়েক দিনের জন্য তোমার বাবার বাড়িতে ঘুরে আসা উচিৎ।কারণ তোমার মন ভালো হবে।”
রাশেদের কথায় ইখুম চাপা হাসি হাসে। তাকে ঘুরে আসতে বলার কারণ সে জানে।
আগামী পরশু রাশেদ স্নেহাকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে। ফর্মে মায়ের নাম সামিনা আর বাবার নামের জায়গায় থাকবে “রাশেদ।”
গভীর রাতে ইখুমের ঘুম ভাঙে, দরজায় কারো মৃদু কড়াঘাত। রাশেদ বেরিয়ে যায় চোরের মতোন।মিনিট দুয়েক পর ইখুম কান পাতে দরজায়।সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মেঝ ভাবীর ঘর থেকে ভেসে আসছে হালকা গোঙানির শব্দ।
চলবে
#এক কাপ চা
পর্ব ১
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
.