#এক কাপ চা পর্ব ১৭
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ১৭
(৪৯)
ধোঁয়া উঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সাগরিকা বলল,
“পানি খাবো।”
তাশদীদ ওর দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইল।চোখে মুখে যথা সম্ভব বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন পানি?চা মুখে দেওয়ার পর?”
সাগরিকা তাশদীদের কথায় ফাটা বেলুনের মতোন চুপসে গেল। মাথা নিচু করে বসে রইল সে৷
হিল খুলে ফেলেছে অনেক সময়। পাকা রাস্তায় হাটছিল তাই পায়ে তেমন বালি লাগে নি।কিন্তু দোকানের সামনে পুরোটা বালি মাটি। পায়ের বুড়ো আংগুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে নিজেকে প্রশ্ন করল,
“পৃথিবীর সব আশ্চর্য অভ্যেস আমার কেন?চা মুখে দিলেই পানি কেন পিপাসা পায়?”
মুখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেল তাশদীদ তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছে। দুই ঢোক পানি গিলে পুনরায় চায়ে চুমুক দিলো সে। তাদের সকালের নাস্তা হয়ে গেল
চা, চিতই পিঠা এবং সরিষার মরিচ বাটা দিয়ে। মরিচ বাটায় এতটা ঝাল ছিল যে সাগরিকার দুই ঠোঁট রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তার দিকে তাকিয়ে তাশদীদ বলল,
“কষ্ট হচ্ছে?”
“না, খুব ঝাল।”
“মিষ্টি খাবি?”
“না। মিষ্টিতে ঝাল কমে না কী?ঝাল কমানোর জন্য তো রুটি বা ব্রেড জাতীয় কিছুর প্রয়োজন।মোট কথা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার আপনার ঝাল কমিয়ে দিবে।
খুব ঝাল যখন লাগবে তখন আপনি একটু রুটি বা সাদা ভাত খেয়ে দেখবেন। অথবা এখন এই একটু সাদা ভাত খেয়ে দেখুন।ঝাল কমে যাবে।”
“বুঝলাম।তবে কী নিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছে আছে তোর?”
“আমার আর ইচ্ছে।পড়তে হবে সেই ভার্সিটি, সেই সাবজেক্ট যা আপনি ঠিক করবেন।”
বলেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সাগরিকা। শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো।অনাবৃত কোমরের অংশে শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে চুল গুলো হাত খোপা করে বলল,
“এবার ফিরবো না?”
“কেন?”
“না জিজ্ঞেস করছিলাম।”
গাড়িতে উঠে বসে সাগরিকা সিট বেল লাগাতেই তাশদীদ জিজ্ঞেস করলো,
“আমার উপস্থিত কিংবা সিদ্ধান্ত তোর অপছন্দ তাই না?”
সাগরিকা চুপচাপ বসে আছে৷ দৃষ্টি বাহিরের দিকে।হ্যাঁ সত্যি তাশদীদের এই হুটহাট স্পর্শ করা কিংবা তার সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সাগরিকার পছন্দ নয়। সাগরিকার এখন নিজের মতামত দেওয়া এবং পছন্দের একটা স্বাধীনতার প্রয়োজন যা সবার থাকে। কিন্তু সে নিজ ইচ্ছে মতোন পোশাক অবধি পরতে পারে না। এই যেমন তার জিন্স পছন্দ। কিন্তু তাশদীদ পছন্দ করে না বলে কখনো কেনাই হয়নি।তার পছন্দ চুল গুলো হালকা বাদামী রঙের হবে কিন্তু তাশদীদের কড়া আদেশ। তুলি বা সাগরিকা যেন চুলে রঙ না লাগায়,ভ্রু-প্লাগ না করে।
সে চায় সবার মতোন বন্ধুদের সাথে বাহিরে যেতে, পিকনিকে যেতে,ট্যুর দিতে কিন্তু তার মতামতের কোনো দাম নেই।তাশদীদ যা বলবে তাই।
সাগরিকাকে চুপ থাকতে দেখে তাশদীদ বলল,
“বেশ, তবে তাই হোক। তোর কোনো বিষয়ে আজ থেকে
আমার কোনো কথা থাকবে না।”
“আমার আঠারো হয়েছে। আমি সবটা না হলেও নিজের ভালো টা বুঝবো ভাইয়া।”
তাশদীদ কোনো জবাব দেয়নি। শুধু গাড়ির গতি কিছুটা নয় অনেকটা বেড়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সে ফিরতে চায়। কারণ অঘোষিত ভালোবাসা যে বড্ড পোড়ায়।
(৫০)
তাশদীদদের গাড়ি এসে থেমেছে তাদের দাদার বাড়ি। প্রায় বিশ কাঠা জমির উপর তাদের এই বনেদি পরিবারের বসবাস। ঝড় যতই আসুক না কেন এই বাড়িকে সামলে রেখেছে তার দাদী।
বাড়ির আশেপাশে অনেক ফলের গাছ। সব ধরনের ফল গাছ আছে। গোয়ালে গোটা পঞ্চাশেক গরু। সবজির বাগান। শিমুল গাছ আর শান বাঁধানো পুকুর।
গাড়ি থামিয়ে সাগরিকা ভেবেছিল তাশদীদ সোজাসুজি বাড়িতে চলে যাবে। কারণ সে হয়তো রাগ করেছে। কিন্তু তাশদীদ ফিরে যায়নি।দরজা খুলে উপরের দিকটায় হাত রেখে সাগরিকাকে বলল নেমে আসতে। এমন কাজ সে সব সময় করে।যাতে গাড়ির উপরের অংশের সাথে কখনো সাগরিকার মাথা লেগে সে ব্যথা না পায়।
কারণ সাগরিকা এবং প্রতিটি ব্যথার মাঝেই সে ঢাল হয়ে থাকে সব সময়।
ওদের দুজন কে দেখে দাদী কিছুটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।যেন সে আশা করেনি তাদের এই খানে। ভদ্রমহিলা লাউয়ের মাচা থেকে লাউ পাড়াচ্ছিলেন বাড়ির কাজের লোক দিয়ে। ওদের দেখে কাছাকাছি গিয়ে বললেন,
“তোমরা এত সকালে?”
“ভিতরে চলো দাদী।”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ভাবলেন তার পর বললেন চলো চলো ভিতরে চলো।শীতে হাত পা নীল হইয়া গেছে। ওই ওদের হাত পা ধুয়নের গরম পানি দে।
ফ্রেশ হয়ে বসতেই তাদের জন্য গরুর দুধ নিয়ে এলেন তাদের দাদী।সদ্য ফোটানো দুধ। বড় বড় গ্লাসে করে এগিয়ে দিলেন ওদের দিকে।তাশদীদ কোনো কথা না বলে ঢকঢক করে সবটা শেষ করলো। সাগরিকা তখনো হাতে নিয়ে বসে আছে। ভেবেছিল তাশদীদ ধমক দিবে কিন্তু কিছুই বলল না।হঠাৎ সাগরিকার মনে হলো সে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে তাশদীদের নজর থেকে।তাশদীদ তাকে দেখতে পারছে না।
বাহিরে যাওয়ার সময় তাশদীদ ভুলে ফোন ফেলে গেছে।সাগরিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রাশেদ, তার বাবার অনেকগুলো মিসড কল।ফোন হাতে নিতেই আবার কল এলো রাশেদের। রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই রাশেদ বলল,
“তাশদীদ মা স্ট্রোক করেছে। তাকে হাসপাতালে নিচ্ছে। তুই যেখানেই থাকিস না কেন জলদি বাড়িতে চলে আয়।আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।”
রাশেদের কথায় দাঁত মুখ এক করে সাগরিকা জবাব দিলো,
“তোমার বুইড়া খাইস্টটা মায়ের কিছুই হয়নি।শয়তান বুড়ি পুরো বাড়ি ধেই ধেই করে নাঁচতেছে।লাউ বিক্রি করতেছে। ও বুড়ি মরবে? স্ট্রোক তাকে দেখে স্ট্রোক করবে।তোমরা আসো আমরা বাড়িতেই।”
রাশেদ জান-পরাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”
“মানে তোমাদের মিথ্যে বলেছে।”
(৫১)
মানুষ
কতটা অসহায় হলে আত্মহত্যার চিন্তা করতে পারে?
কে বলেছে পুরুষ মানুষ নিরুপায়, অসহায় হয় না?
তাদের সৃষ্টি কর্তা শক্ত আবরণ দিয়েছে কিন্তু তাদের ভিতরেও একটা মানুষ বাস করে। কিন্তু সমাজের চোখে সে মানুষ দেখিয়ে বেড়ানো যায় না।
রাশেদ নিজেকে বড্ড একা মনে করে ইদানীং। কিছুক্ষণ পূর্বে বাড়িতে এসেছে তারা৷ স্পষ্ট তার মা মিথ্যে বলেছে।ইখুমকে কিছু বলতে পারেনি রাশেদ।
ইখুমকে পাশে নিয়ে তার পথ চলা হবে না।মেয়েটার দোষ নেই।দোষ তার ভাগ্যের। কিন্তু আজ যখন ইখুম বলেছে সে মুক্তি চায় তখন না হয় তাকে মুক্তিই দিবে সে।
ইখুম কে তালাক দিয়ে সামিনাকে বিয়ে মানবিক মর্যাদায় কতটা মহান তার মা তাকে বুঝিয়েছে। সে বুঝেছে। কিন্তু সব বুঝলেই কী করতে হবে।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে রেল লাইনের পাশে এলো রাশেদ। দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে।
বিকেল তিনটা বেজে সাত মিনিট। খবর এলো রেল লাইনে একজন মানুষ কাটা পড়েছে। তার লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে রেল লাইনের উপর।
চলবে ……..