#এক কাপ চা
পর্ব ১৮
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৫২)
চা’য়ের কাপে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করছিল সাগরিকা।বিনা নোটিশে তার পুরো চৌদ্দ গুষ্টি হাজির হয়েছে গ্রামের বাড়িতে। অবশ্য এখানে আসার পর বুড়ি তার সুর পাল্টে বলেছে যে তার না কী তার সব ছেলে মেয়েকে এক সাথে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই সে মিথ্যে বলে সবাইকে খবর পাঠিয়েছে। বিশাল সাইজের উনুনে কাঠ দিয়ে চলছে রান্না।তুলির মা -বাবা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সে মায়ের কাছে আছে। সাগরিকা বসে আছে ইখুমের পাশে। তাজবীদ বাড়িতে প্রবেশ করেই হুকুম দিয়েছে চা বানানোর। অগ্যতা চা নিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু ইখুমের চাপা স্বরে কান্নায় থামে সে।
চায়ের কাপ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ছোটো চাচ্চুকে খুব ভালোবাসো তাই না?”
“না।”
“তবে কাঁদছো কেন?”
“তুমি বুঝবে না।”
“আচ্ছা তোমার কেমন লাগছে চাচ্চুর উপর রাগ করে?ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ভিতরে?না কী মনে একটা অস্বস্তি হচ্ছে?”
ইখুম জবাব দেয়নি।তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। তার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে হলুদের সমারোহ। সরিষার ফুলে ছেয়ে আছে পুরো মাঠ। মাঠ পেরিয়েই রেল লাইন। কিছুক্ষণ পূর্বে খবর এসেছে রেল লাইনে কাটা পড়ে একজন মানুষ মারা গেছে।এটা শোনার পর ইখুমের অস্বস্তি আরো দ্বিগুণ হয়েছে।
এ বাড়িতে আসার পর আজ এক দফা রাশেদের সাথে তর্ক বির্তক হয়েছে। তর্কের এক পর্যায়ে ইখুম তার থেকে মুক্তি চেয়েছে। রাশেদ বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলেছিল সে শুধু ইখুম নয় সবাইকেই মুক্তি দিবে।
ট্রেনে কাটা পড়া মানুষের খবর এসেছে। নিজেকে কোনো ভাবে টেনে নিয়ে দরজার হাতল ধরে দাঁড়ালো ইখুম।
একজন দিন মজুর কাটা পড়েছে ট্রেনে।ট্রেনের ছাদে করে কাজ থেকে ফিরছিলো।সবার ধারণা ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর ছাদ থেকে পড়ে সরাসরি ট্রেনের নিচে চলে যায়। লাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না।
বস্তায় করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তাশদীদ কথাগুলো বলছিল। তাশদীদের কথায় ইখুম কিছুটা স্বস্তি পেলেও রাশেদ ফিরেনি দেখে তার আবার চিন্তা হতে লাগলো।সে সময় রাশেদ ঘরে প্রবেশ করলো হাতে পাকা কদবেল ভর্তা নিয়ে।ধনিয়া পাতা, লবণ মরিচ এবং চিনি দিয়ে বানানো কদবেল ভর্তা ইখুমের সব থেকে প্রিয়। ঘরে প্রবেশ করে টেবিলের উপর কদবেল ভর্তা রেখে বলল,
“আমার সাথে রাগ আছে থাকুক।খাবারের সাথে দেখিও না।”
(৫৩)
মৌসুমিকে দেখে রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে সাগরিকার। বেহায়া মেয়েটা এখানেও হাজির। নানীর সাথে পড়ে ভালো।দুটোই কুটনি তো তাই পড়ে ভালো।পিছন ফিরে রাশেদকে দেখে সাগরিকা জিজ্ঞেস করলো,
“চাচ্চু!মুনির ভাই বিয়ে করেনি?”
“করেছে।”
“কাকে?”
“কনে কেই বিয়ে করেছে। কেউ একজন কনেকে নিচ তলার রান্নাঘরের পাশের রুমে বন্ধ করে রেখেছিল।”
“আশ্চর্য! বুঝলে কীভাবে?
“
“একজন ওয়েটার তার চিৎকার শুনেছিল।”
“এত বড় দামড়িকে আটকে রাখলো আর ও গেল?”
“পরিচিত কেউ নিয়েছিল বলেই গিয়েছিল।”
“কে বলেছে?”
“না, মেয়েটা প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল।তাই আর তাকে ঘাটায়নি কেউ।”
“নিশ্চিত এটা মৌসুমি আপুর কাজ।তাই তো বলি,ভাইয়ার প্রেমের বিয়ে অথচ কনে পালালো কী করে?তাও আবার জানালা দিয়ে?
ভাগ্যিস ওয়েটারটা দেখেছিল।আরেকটা কথা চাচ্চু।”
“বলো রে আমার টেপ রেকর্ডার।”
“তোমার মা, মানে কুটনি বুড়িটা রাঙ্গামা কে দেখতে পারে না কেন?”
“আমি নিজেও জানি না।শুধু বলে আমার পছন্দ না।”
“পারমিশন দিলে একটা অনুমতি চাইতাম।”
“এটা কেমন কথা হলো?”
“দিবে কী না তাই বলো?”
“আচ্ছা বলো।”
“বুড়ির এক পা তো কবরে। ধাক্কা দিয়ে আরেক পা নামানোর ব্যবস্থা করা যায় না?আমাদের সবার শান্তি এতেই।”
সাগরিকার এমন কথায় রাশেদ বিরক্ত হলো না।কারণ সাগরিকা এসব তার মন ভালো করার জন্য চেষ্টা করছে এটা সে খুব ভালো করেই জানে।কিন্তু সাগরিকাকে বুঝতে হবে তামাশার একটা সীমা আছে। রাশেদ কখনো সাগরিকা কিংবা স্নেহাকে ধমক দেয় না।তাদেরকে শান্ত স্বরে বুঝিয়ে বলে।এবারো তাই করলো। সে বলল,
“আমরা সন্তানরা জন্ম থেকেই মা-বাবার কাছে ঋণী থাকি।আমাদের প্রতি তাদের দায়িত্ব থাকে ঈশ্বরপ্রদত্ত।ঠিক তেমনি মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব একই। তাই কারো বাবা- মা সম্পর্কে এমন বলা উচিৎ নয়।”
রাশেদের সাথে কথা বলে ঘরে ফেরার সময় অন্ধকারে সাগরিকা কিছু একটার সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল।পড়ে যাওয়ার আগে তার নাকে এসে ধাক্কা দিয়েছে বেলী ফুলের গন্ধ।ভয়ে চুপসে যাওয়া সাগরিকা মনে মনে যত দোয়া-দরুদ পারে পড়তে লাগলো।আজ কয়েকদিন পর সেই আশিক জীনের সামনাসামনি সে। এর আগে তাকে ঘুমের মধ্যেই অনুভব করতো। আজ এতটা কাছাকাছি দেখে সে হুট করেই কান্না ভুলে বসেছে।চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছে হালকা সাদা রঙের কাপড় পরিহিত একজন সুদর্শন যুবকের হাত এগিয়ে আসছে তার দিকে।সাগরিকার আর কিছুই মনে নেই।
সম্ভবত সে জ্ঞান হারিয়েছে।
(৫৪)
সাগরিকা চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করলো নিজের দাদীর খাটের উপর। তার গায়ে লেপ জড়ালো। মাথাটা রাখা তাশদীদের কাঁধে। এক হাতে সে সাগরিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অন্য হাত ধরে রেখেছে সাগরিকার কাঁধ।সবাই তখন কোনো একটা বিষয়ে কথা বলছিল।সাগরিকাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে তুলি তার কানে কানে গিয়ে বলল,
“নেশা করছো না কী?”
“কেন?”
“তাহলে ভাইয়াকে এমন ভাবে ধরেছো কেন?অন্য কেউ ধরতে গেলেই বলছো তোমাকে না ধরতে। শুধু ভাইয়ার নাম ধরে ডাকতেছো।”
সাগরিকা মুখ তুলে তাকিয়ে তাশদীদের দিকে একবার তাকালো। তার কপালের শিরা হঠাৎ করেই ফুলে উঠেছে। সে রেগে আছে এটা স্পষ্ট। কয়েক মুহুর্ত যেতে না যেতেই তাশদীদ বলল,
“দাদু এটা তোমার অন্যায় আবদার।তুমি এমন চিন্তা করো কী করে?”
“স্নেহার ভালোর জন্য করি।”
“আশ্চর্য! এটা কোনো সমাধান নয়। তুমি কাকার উপর এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারো না।”
“আমার ইখুম পছন্দ না।”
“কিন্তু কেন?”
“পছন্দ না মানে না।ওই মেয়েকে বিয়ের সময় আমি অনুমতি দিয়েছি।এবার ও আমার পছন্দের বিয়ে করবে।”
“না এটা হয় না।”
তাশদীদের বাবা, মা সবাই মিলে রাশেদের হয়ে আজ কথা বলল।এটা তার মায়ের বাচ্চাদের মতোন জেদ করাটাকে কেউ পশ্রয় না নিয়ে সবাই তাকে বুঝিয়ে বলছিল।এমন সময় সামিনা এসে তার শাশুড়ির হাত ধরে বলল,
“মা আমার ভাগ্যে এই বাড়ির ভাত থাকলে একাই আসবে। আপনি আমার উপর দয়া করুন। আমার উপর একটু দয়া করুন মা।
আর তাদের বলে দিন আমি বা আমার মেয়ে কারো কাছে বোঝা হতে চাই না।যদি না পারেন তবে নিজ হাতে আমাকে আর আমার মেয়েকে মেরে ফেলুন।তবুও আমাদের জন্য আর এসব বলে নিজেকে কথার ভাগীদার করিয়েন না।”
চলবে ….