#ফাবিয়াহ্_মমো
বির্দীর্ণ আকাশ চিড়ে বজ্রপাতের মতো কারোর হাউমাউ কান্নার প্রলাপ ভেসে আসছে! রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগানো সত্ত্বেও গগনচুম্বী কান্নার তপ্তধ্বনি ড্রয়িংরুম পযর্ন্ত স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে! প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় এদিক ওদিক পায়চারি করছে আয়মান! শ্রেয়া সোফায় বসে মাথা নিচের দিকে নুয়ে চুপিসারে কাঁদছে! দুপুরের বিভৎস ঘটনাটা পূর্ণতার নরম মনে বিষাক্ত হুলের মতো এখনো বিদ্ধ করছে! ওয়াশরুমের ঝর্ণা ছেড়ে মাথার চুল টেনে ফ্লোরে বসে আত্মহুতির মতো বিলোপ করছে পূর্ণতা! ছোটবেলার বন্ধু কেন অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করলো? একসাথে খেলাধুলা করা চারটে সাথীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলেবন্ধুটা এতো জঘন্যতম কাজ করলো?ধিক্কার! পূর্ণতা ফ্লোর থেকে উঠে দেয়ালে দুইহাত রেখে সজোরে নিজের মাথা দেয়ালে বারি দিলো! দারুন শব্দ হলো একটা! আয়মান ও শ্রেয়া চমকে উঠে পূর্ণতার বন্ধ রুমের দরজা ধাক্কাতে লাগলো!
– পূর্ণতা বইন!! নিজের ক্ষতি করিস না! দরজাটা খোল হারামি!
– প্লিজ দোস্ত, দরজা খোল!! পূর্ণতা একটাবার দরজা খোল না…
শ্রেয়া দরজায় ধাক্কাতে ধাক্কাতে হু হু করে মাথা নুয়ে কেদেঁ দিলো। আয়মান শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার জো খুঁজে পেলো না। শ্রেয়ার মাথায় অকপটভাবে হাত রেখে বললো,
– প্লিজ শ্রেয়া কাদিঁস না। তুই কাদঁলে….
শ্রেয়া আয়মানের কথায় মুখ তুলে তাকায়। আয়মান চট করে কথা ঘুরিয়ে ওর মাথা থেকে হাত সরিয়ে বলে উঠে,
– নাক মুছ খাচ্চর! পুরা খাচ্চরের লাগান লাগতাছে!
আয়মান কথার প্রসঙ্গ পাল্টে আবার দরজা ধাক্কা দেওয়ায় মগ্ন হলে শ্রেয়া হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে নাক মুছে। দরজায় কান লাগিয়ে ভেতর থেকে কিছু শোনার চেষ্টা করছে আয়মান। নাহ্…ঝর্ণার হালকা শব্দ ছাড়া কিচ্ছু শোনা যাচ্ছেনা! আয়মান ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে সোফার কাছে যেয়ে দাড়ালো। ফোনের কিপ্যাডে নাম্বার ডায়াল করতেই শ্রেয়াকে বলে উঠলো,
– শ্রেয়া? দরজা থেকে সরে আয়। সোফায় বস!
শ্রেয়া আয়মানের কঠোর নির্দেশনা পেয়ে বিস্ফোরিত চোখে গুটিগুটি পায়ে সোফায় যেয়ে বসতেই বলে উঠে,
– কাকে কল দিচ্ছিস আয়মান?
– যাকে কল দিলে পূর্ণতা এই মূহুর্তে ঠান্ডা হবে!
– মানে? শ্রেয়ার কন্ঠে স্পষ্ট কৌতুহল!
– মানে টানের উত্তর দেওয়ার সময় নাই! চুপচাপ বসতে বলছি! বস!
আয়মান কানে ফোন এটেঁ কাউকে কলের বিপরীতে বলে উঠলো,
– আসসালামুয়ালাইকুম বড় ভাই, কেমন আছেন?
ওপাশ থেকে হাসিমুখের উত্তর,
– আরে আয়মান দেখি! হঠাৎ কি মনে করে স্মরন করলা মিয়া? ভুইলাই গেছো ফোনই দেওনা।
– বইলেন না বড় ভাই। সেমিস্টারের যেই চাপ! শালার পড়ালেখা খাইয়া দিছে। ভাই? একটা দরকার ছিলো,
– ফর্মালিটি করিস না বেটা! বল কি দরকার?
– ওয়াকিল ভাই? একজনের নাম্বার লাগবো আর্জেন্ট! বুঝছো? একটু তাড়াতাড়ি দিতে পারবা?
– আর্জেন্ট? আচ্ছা নাম কও।
– পূর্ব বসের নাম্বারটা একটু লাগতো ভাই! একটু প্রাইভেট টক করতাম।
– উনার নাম্বার লাগবো? কিও পলিটিক্স করতে ইচ্ছা জাগছে নি?
– হা হা…ওই আরকি একটু ডিসকাস সারতাম। দেওয়া যায়?
– আমার কাছে তো নাই। আমি দেখি ম্যানেজ করে দিতেছি। দশটা মিনিট সময় দাও।
– আচ্ছা ভাই। তাহলে একদিন টিএসসি মোড়ে আসতেছি। চা চাই কিন্তু!
– আবার জিগায়!! আইসা পরবা! বিলের জন্য ফিকার নট!
– রাখি ভাই, আল্লাহ্ হাফেজ।
শ্রেয়া অনেকক্ষন পর বুঝতে পারলো আয়মান খুবই চাটুকারিতার সাথে পূর্বের নাম্বার ম্যানেজ করে ফেলেছে! ইশশ…চোর গেলে বুদ্ধি আসে! আগেই যদি ওয়াকিলকে ধরে পূর্বের নাম্বার জোগাড় করতো তাহলে এমন কষ্টভোগ পূর্ণতার করতে হতো না! পূর্বের সাথে ঠিকই ফোনে যোগাযোগ করতে পারতো। ওয়াকিল ওর কথামতো ঠিক পনের-দশ মিনিটের মধ্যে পূর্বের নাম্বার টেক্সট করে পাঠায়। আয়মান চাতক পাখির মতো ব্যকুল হয়ে ছিলো যেই টেক্সট দেখলো ওমনেই ধুপধাপ কল! শ্রেয়া সোফা ছেড়ে আয়মানের পাশে হাত নাড়াচাড়া করে চিন্তা করছে। এদিকে ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! পূর্ব রিসিভ করছেনা! আয়মানের সন্দেহ হলো, এটা কি আদৌ পূর্বের নাম্বার? ধরছেনা কেনো? আবার ট্রায় করতেই ওপাশ থেকে ভারী গলার কন্ঠ,
– হ্যালো, ওয়াসিফ পূর্ব বলছি। পরিচয় দিন।
পূর্বের উত্তর শুনে বোঝা গেলো পূর্ব এসব আননোন নাম্বারের সাথে খুবই পরিচিত। প্রায়ই নানা নাম্বার থেকে হুটহাট কল আসে আর পূর্ব এমন করেই সর্বপ্রথম নিজের পরিচয় উপস্থাপন করে।
– আসসালামুয়ালাইকুম, বস। আপনার সাথে খুবই জরুরী কথা ছিলো!!
– ওলাইকুমসসালাম। জ্বি বলুন।
– বস! আমি পূর্ণতার বন্ধু আয়মান বলছি। পূর্ণতার সাথে….
আয়মান কথাটা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলো! কি করে স্পষ্ট ভাষায় বলবে পূর্ণতার সাথে কি হতে যাচ্ছিলো? আয়মান চোখ ঘুরিয়ে শ্রেয়ার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে খুবই আস্তে করে প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে বললো,
– পূর্ণতার…খারাপ…কিছু…
আয়মান চোখ বন্ধ করে কথাটুকু গিলে এক নিশ্বাসে হড়বড় করে বলে উঠলো,
– আপনি এক্ষুনি ওর বাসায় আসেন বস! পূর্ণতা ভালো নেই! রুমের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছে! একটু আগে খুব জোরে শব্দ হয়েছে…
আয়মানের বলাটা শেষ না হতেই টুট টুট টুট করে ফোনের ওপাশ থেকে লাগাতার একটা টোন আসতেই আয়মান হকচকিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে, ‘The call is dropped’. পূর্ব কল কেটে দিয়েছে? পূর্ব কি আসবে নাকি তোয়াক্কা না করে হেলা করবে? উপস্থিত আয়মান ও শ্রেয়ার মধ্যে প্রশ্নের প্রচুর ঝড় উঠছে!!কি করবে পূর্ব?
ঘড়ির কাটা সাতটা বেজে বিশ মিনিটে টিক টিক করে ক্লকওয়াইজ ঘুরছে। পূর্ণতার দরজা খোলার অপেক্ষা করতে করতে পেরিয়ে গেছে দেড়ঘন্টা! শ্রেয়া ও আয়মান নিজেদের বাসায় বলে দিয়েছে আজ ওরা পূর্ণতার বাসায় পার্টি করবে। খোদেজা এখনো কিছুই জানেনা। একটু আগে ফোন করে জানিয়েছে রাতে তিনটা ডেলিভারির পেশেন্টের জন্য বাসায় ফিরতে পারবেনা। পূর্ণতার বাবা ব্যবসার তাগিদে দেশের বাইরে গিয়েছেন। বলতে গেলে সবসময়ের মতো পূর্ণতা বাসায় একা। হঠাৎ কলিংবেল বাজার শব্দ হলে নূরানী রান্নাঘর থেকে হন্তদন্তে বেরিয়ে দরজা খুলে। গায়ে কালো হুডি পরা, মাথায় শক্ত করে হুডি টানা, চুলের কারনে চোখ দেখা যাচ্ছে না, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, কে উনি বোঝা যাচ্ছেনা। নূরানী ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
– কেডায় আপনে? কারে চান?
– এটা পূর্ণতার ফ্ল্যাট না?
নূরানী কয়েকধাপ বেশি কৌতুহল নিয়ে ভ্রু কুচকায়! রাজিব শয়তানটা আবার লোক পাঠালো নাকি? নূরানী দরজা ধরে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে আয়মান ও শ্রেয়াকে ডাকে,
– আয়মান ভাই? ও শ্রেয়া আপা? এ কেডায় জানি আইসে। আপার খবর জিগায়?
আয়মান বিশিষ্ট দৌড় প্রতিযোগী উসাইন বোল্টের মতো অনেকটা দৌড়ে এসে বাইরে থাকা ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে বললো,
– পূর্ব বস?
– হু।
আয়মান তাড়াতাড়ি দরজা থেকে নূরানীকে সরতে বলে পূর্ণতার দরজার কাছে নিয়ে গেলো। শ্রেয়া পূর্বের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পৃথিবীতে এলিয়েন জীবটা পর্দাপন করেছে। পূর্ব সার্জিক্যাল মাস্কটা থুতনিতে নামিয়ে বলে উঠলো,
– পাজিটার কি হয়েছে? দরজা বন্ধ কেন?
শ্রেয়া ধাক্কা খেলো পূর্বের মুখে পূর্ণতার ইঙ্গিতবার্তা শুনে। কোনো বাবু সোনা না ডেকে ডিরেক্ট পাজি বলে সম্বোধন করলো? শ্রেয়াকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়মান পুরো ঘটনা বর্ননা বিশ্লেষণ করে বললো। পূর্ব চমকিত কন্ঠে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে উঠে,
– দরজা ভাঙলে প্রবলেম হবে? কুইক বলো!
– বস্, এটা আন্টির রুম। এই রুমের দরজা ভাঙ্গলে আন্টি পূর্ণতাকে বকবে। আমরা চাচ্ছিনা আন্টি এ বিষয়ে এখনই কিছু জানুক।
– এক্সট্রা চাবি? নবের লক খুলার জন্য কোনো চাবি নেই?
– না বস্।
– বস্ বস্ করবে না! ভাই ডাকো! একটা প্লাস্টিকের মোটা কাগজ দাও! ফাইলের মলাটে যেরূপ প্লাস্টিক কাগজ থাকে আনো!
আয়মান নূরানীকে বলে পুরোনো ফাইলের মলাট এনে পূর্বের হাতে দিলে পূর্ব সেটা খুব টেকনিক্যালি দরজার সরু চিপায় ঢুকিয়ে নব বরাবর নিচের দিকে একটান মারে! নব কিভাবে যেনো খুলে যায়! অবুঝের মতো তাকিয়ে আছে আয়মান আর শ্রেয়া। ততোক্ষনে পূর্ব ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
পূর্ব থুতনি থেকে টান মেরে মাস্ক খুলে পকেটে রাখতেই রুমের ভেতর পানির শব্দটা শুনতে পায়! পূর্ব বামপাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে ওয়াশরুমের দরজা আধ খোলা সেখান থেকে আসছে ঝর্ণার শব্দটা! দরজায় আলতো ধাক্কা দিতেই হতভম্বের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় পূর্ব! হাটুভেঙ্গে ধপ করে দরজার বাইরে বসে পরে। পূর্ণতা একটা ভারী বস্তু পরার মতো শব্দ পেয়ে আলতো করে মাথা উঠিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে কাউকে দেখতে পায়। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে পূর্ণতার। কপালের একপাশে উচুস্তম্ভের মতো ফুলে নীল বর্ণ ধারন করেছে। শাওয়ার পানিতে পুরো শরীর ভিজে একাকার অবস্থা, অল্পবিস্তর গা কাপছে। চোখের সামনে সব সাদা পর্দার মতো ছেয়ে আছে কয়েকবার চোখ ঝাপটা মেরেও পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেনা। বিষন্ন গলায় কেউ বিচলিত হয়ে বলে উঠলো,
– নিজের কি হাল করেছো তুমি পূর্ণ? এই দৃশ্য দেখার চেয়ে আমাকে মেরে ফেলো।
পূর্ণতা আরেকবার চোখ ঝাপটা মেরে ভ্রু কুচকাতেই কপালের চামড়ায় টান লেগে ব্যথিত সুরে ‘আহ্’ চোখ বন্ধ করে ফেলল। আমি কি কানে ভুল শুনলাম? আমার অবচেতন মন কি আবারো হ্যালুয়েশন দেখছে? আমি মরলেও তো পূর্বের এখানে আসার কথা না! দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দামী মানুষটা আমার জন্য এখানে আসবে? অসম্ভবের চেয়েও ব্যাপক অসম্ভব! হঠাৎ আমার মাথা উপর থেকে শাওয়ারের পানি আর গায়ে পরছেনা! আমার শরীরের উপর যেনো কিছু একটা দেওয়া। আমি ঝট করে চোখ খুলে দেখি পূর্ব ক্লথ হ্যাঙ্কারে আমার শুকনো জামা রাখছেন। আমার শরীরের উপর শুকনো টাওয়াল দেওয়া। আমাকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি দ্রুতবেগে বলে উঠলেন,
– ভেজা কাপড় চেন্জ করে বাইরে আসো।
উনি উল্কা স্পিডে চা চালিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দরজা টেনে দিলেন। আমি পানির ট্যাপ ধরে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেই। কপালের ডানপাশে ব্যথায় টনটন করছে। কপালে ভাজ ফেলতে পারছিনা। অসহ্য ব্যথা করছে! ভেজা কাপড় পাল্টে শুকনো কাপড় গায়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বারান্দায় গিয়ে ভেজা জামাকাপড় তারে রাখলাম। পূর্ব আমার বিছানায় শুয়ে মাথার নিচে দুহাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছেন। উনি সম্ভবত আমার উপস্থিতি পাননি। তবে পেয়েছেন কিনা তাও তো জানিনা সবসময় নরমাল হয়ে থাকেন বোঝার উপায় নেই। বাইরে চাদেঁর আলোটা ধীরে ধীরে খোলাশা হয়ে কিরন বিকাচ্ছে। কি দারুন লাগছে এখন!! বারান্দার গ্রিল ধরে আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে আকাশ দেখছি। হঠাৎ আমার পিছন থেকে উনার সাবধানী পায়ের আওয়াজ এসে দোলনার কাছে থেমে গেলো।
– পূর্ণ পিছনে ঘুরো।
আমি পিছনে ঘুরে গ্রিল থেকে হাত সরিয়ে তাকালাম। পূর্ব চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো দেখছেন। একটু পর দুহাত দুপাশে মেলে কাছে ডেকে বলে উঠলেন,
– আমার কাছে আসো প্লিজ। দূরে দাড়িয়ে থেকো না।
আমাকে নির্বিবেকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি দোলনা থেকে উঠে আমাকে টান দিয়ে উনার পাশে বসিয়ে নিলেন। উনার মাথা থেকে পুরো শরীর একটা কালো হুডিতে জবুথবু। উনার বেশভূষা দেখে চট করে মাথায় প্রশ্নের চিহ্ন ঝুলে গেলো উনি আজ এভাবে কেন? পূর্ব হুডির চেইনটা উপর থেকে নিচে একটান দিয়ে খুলে সেটাকে পাশের বেতের মোড়ার উপর রেখে দিলেন। গায়ে উনার আসমানী রঙের শার্ট। হুডির কারনে উনার চুল পুরো এলোথেলো হয়ে আছে। পূর্ব হাতের ঘড়িটা খুলে হুডির উপর রেখে শার্টের হাতা ফোল্ড করতেই বলে উঠলেন,
– একটু আগে কি দেখলাম আমি? ওভাবে মেন্টালের মতো ওয়াশরুমে ভিজছিলে কেন? মাথা কি নষ্ট?
আমি ঘোরের মধ্যে জবাব দিলাম,
– আপনি কি আমার হ্যালুয়েশন?
উনি কপাল এমনভাবে কুচকালেন যেন আমি খারাপ কিছু বলে অপরাধ করে ফেলেছি। উনি গম্ভীর গলায় রাগ দেখিয়ে বলে উঠলেন,
– আমাকে তোমার হ্যালুসিয়েশন লাগে? ইয়ার্কি করছো? আমি কক্ষনো এই টাইমে আসতাম না! তোমার বন্ধু যদি আমাকে খবর না দিতো মরে তো লাশ হয়ে থাকতে!
চোখ থেকে জল টপটপ করে ঠোটেঁর উপর বিন্দু বিন্দু পরছে আমার। আমি কি আদৌ উনার জীবনে একজিস্ট করি? আমার তো এই লুকোচুরি, চুপিচুপি দেখা সাক্ষাৎ করতে ভালো লাগেনা। স্বাভাবিক একটা সম্পর্কের মতো চলতে ইচ্ছে করে যা আমি কখনোই পূর্বের কাছ থেকে পাইনা। আমি মরলেই কি বেটার হতো না? উনার এতো মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার জন্য কষ্ট করে আসতে হতো না। উনি আমার উপর রাগ দেখিয়ে মুখ ঘুরিয়ে আকাশে দৃষ্টি দিয়েছেন।। উনার যে রাগ প্রচুর লাগছে তা হাতের মুষ্ঠিবদ্ধ থরথর কাপুনিতেই বুঝে গিয়েছি। আমি নিচু গলায় চোখ নামিয়ে বলে উঠি,
– আপনি তাহলে চলে যান। আপনার মতো ব্যস্ত মানুষের জীবনে একটা তুচ্ছ মানুষের যেহেতু মূল্য নেই আমি দুঃখিত। আমি প্রচণ্ড বেহায়া হয়ে গিয়েছি। চিন্তা নেই ভাবনা নেই…হুটহাট আপনার জন্য পাগলামি করি। মাফ করে দিবেন। আমার জন্য আর আসতে হবেনা। আজই শেষ। আমি অবশ্যই নিজের সর্বস্ব চেষ্টা করবো ভুলে…
উনি এমন ক্ষিপ্র গতিতে আমার উপর ঝাপিঁয়ে পরলেন আমি কয়েকসেকেন্ড স্তব্ধ ছিলাম কি হলো আমার সাথে। উনি আমার ভেজা চুলোগুলোতে আগের মতোই আঙ্গুলের শক্তযোগে খামচে ধরে আমার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে জাপটে ধরেছেন। অস্থির লাগছে পূর্বকে! এই পূর্বকে আমি চিনিনা! উনি অস্ফুটিত কন্ঠে এতোই নিচু করে বলছেন যে আমার শুনতে প্রচুর সজাগ থাকতে হলো।
– এই কথাগুলো বলার আগে চিন্তা করেছো আমাকে কি পরিমাণ কষ্ট দিলে? আমি তোমার জন্য কি কি করছি তুমি জানো না পূর্ণ। আমারও কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয় এভাবে লম্বা সময় পর পর তোমার সাথে দেখা করতে। মরিয়া হয়ে উঠি আমি। তবুও আমি তোমার সাথে দেখার করার সাহস পাই না। আমার একটা ভুলের জন্য যদি তোমার ক্ষতি হয় আমি খতম হয়ে যাবো পূর্ণ!
পূর্বকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম উনি ছাড়লেন না। উনার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত সুরে বলে উঠলাম,
– আপনার যদি বেশি সমস্যা হয় আপনি সব বিচ্ছিন্ন করতে পারেন। আমি আর কষ্ট পাবো না।
উনি আরেকদফায় জোরে চেপে ধরলেন। আমার শরীরের হাড্ডিগুলো ভেঙ্গে ঝুলে পরে কিনা কে জানে? আমি উনার কানের কাছে মুখ এনে বলে উঠলাম,
– কি অধিকারে আপনি ধরে রেখেছেন বলুন? একটু আগেই তো বললেন আপনি কক্ষনো আসতেন না। এখন ছেড়ে দিয়ে চলে যান।
উনি আমার চুলে তীব্রভাবে খামচে ধরলেন। কষ্ট দিচ্ছেন উনি! এখন টর্চার করছেন আমার উপর! কিছুক্ষণ পর উনি আমায় ছেড়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বসতেই ফের আমার হাত টান দিয়ে উনার কোলে বসিয়ে নিলেন। আমার দুহাত উনার গলা জড়িয়ে রেখে গালে হাত বলে উঠলেন,
– আমায় বিয়ে করবে?
– কককি..
– তোতলাচ্ছো কেন? বলো বিয়ে করবে আমায়?
– আপপনি ঠঠিক
– আমি ঠিক আছি। বলো পূর্ণ! আমাকে বিয়ে করা যায় না?
– যায়,
– তোমার বাসায় কি এক্ষুনি প্রস্তাব পাঠাবো? রাত এখনো দশটা বাজে নি। আমি সব ম্যানেজ করতে পারবো।
– আপনি কি বলছেন?
– আমি তিনদিন ধরে বাসায় যেতে পারছিনা। পার্টির কাজে বাইরে ব্যস্ত পূর্ণ। তোমার বন্ধু আয়মান আমাকে কল দিতেই আমি সব ছেড়ে চলে এসেছি। বিশ্বাস কর, তুমি যতোটা না যন্ত্রণায় আছো। তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কষ্ট আমি ভোগ করছি। বলো বিয়ে করবে এখন?
– এখন? মা তো হাসপাতালে। বাবা দেশের বাইরে।
– হাসপাতালের ঠিকানা দাও। আমি এক্ষুনি আমার আব্বুকে বলে প্রস্তাব পাঠাচ্ছি।
– আপনি শান্ত হন…
– আমি শান্ত হতে পারবো না। তুমি কষ্ট পাচ্ছো। আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমার সাথেই থাকবে তুমি। বিয়ের পর চুটিয়ে প্রেম করবো। এভাবে বারবার তোমার কাছে এসে নিজেকে কন্ট্রোললেস বানাতে চাইনা।
– আপনি এগ্রেসিভ হচ্ছেন…
– আমি যে তোমাকে চুমু দিতে পারছিনা এই সমস্যা তুমি বুঝবে? কতটা সীমাবদ্ধতায় রাখতে হচ্ছে জানো? তোমার কষ্ট আমি কমাতে পারছিনা!তোমাকে আমি নিজের সাথে রাখতে পারছিনা। উফফ.. বলো এখন তুমি বিয়েতে রাজি?
পূর্ণতা মোহময় দৃষ্টিতে পূর্বকে দেখছে। একটু আগে কি জিদ উঠছিলো পূর্বর উপর! এখন পূর্বের অবস্থা দেখে বুকটা মোচড় দিচ্ছে পূর্ণতার। পূর্ব যে বিয়ে করার জন্য কতোটা এগ্রেসিভ সেটা ভেবে প্রচণ্ড খুশি লাগছে!! পূর্ণতা পূর্বের তালুর চুলে হাত রেখে পূর্বের লালবর্ণের ঠোঁটদুটোর দিকে এগুতেই ঝট করে পূর্ণতার মুখে হাত রেখে বলে উঠে,
– কি করছো! মেরে ফেলবা নাকি! খরবদার এখন কিছু করো না!
পূর্ণতা হাসিহাসি চোখে পূর্বের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের ঠোঁটের উপর পূর্বের হাত দেখে পূর্ণতা আলতো করে ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয়। পূর্ব ঝটাং করে হাত সরিয়ে বলে উঠে,
– আমার উপর এরকম অত্যাচার করো না পূর্ণ। আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো।
– আপনার এই অবস্থা দেখে আমার মজা লাগছে।
– প্রচুর পাজি হয়ে গিয়েছো। মাইর দেওয়া দরকার। থাপ্পর দিয়ে…
পূর্বের কথা শেষ না হতেই কপালের চুল সরিয়ে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয় পূর্ণতা। ভ্যাবাচেকা খেয়ে চুপ হয়ে যায় পূর্ব। এই মেয়েটা আজ দারুন জালাচ্ছে তো!! একবার বিয়েটা হোক তারপর বুঝবে খেলা! পূর্ণতা মুচকি হেসে বলে উঠে,
– যত কিছুই হোক আপনি যে কন্ট্রোল হারাবেন না এইটুকু ভরসা আমার আছে। কবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন?
– পূর্ণ…
– বলুন।
– বিয়েটা গ্রামে করলে কোনো অসুবিধা হবে?
– গ্রামে করতে চাচ্ছেন?
– শহরের চারধারে যদি তোমাকে বিয়ে করছি এই খবর জানে দ্যান প্রবলেম করতে পারে। আমি চাচ্ছি গ্রামে…
– সেটাই হোক। গ্রামেই হোক। আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতে হলেই আমি খুশি।
– আমি এ সপ্তাহের মধ্যেই সব ফাইনাল করে ফেলছি।
– আমার কিছু চাই পূর্ব।
– বলো,
– আপনার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শুধু একটা ঘন্টা আমার জন্য চাই। একান্ত আমার সময় হিসেবে।
পূর্ব খানিকটা সময় নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো,
– রাত তিনটা থেকে চারটা চলবে?
– গভীর রাতে?
– একটু বুঝো পূর্ণ। আমি তোমাকে দুনিয়ার সামনে সিক্রেট রাখতে চাচ্ছি।
– তাহলে দিন নাম্বার!!
– যেটা দিবো সেটা প্রাইভেট নাম্বার। সাবধান! ভুলেও কাউকে এই নাম্বারের ব্যাপারে বলতে যাবা না। সারাদিন অফ থাকবে জাস্ট রাত তিনটায় অন করবো।
– আজ থাকবেন?
– অসম্ভব। আমি চলে যাবো। আমি কাউকে বলে আসিনি। রাস্তায় কার যে পার্ক করা বাইক উল্টে এসেছি নিজেও জানিনা। এখন যেতে হবে পূর্ণ।
উনি আমার জন্য অন্যের বাইক উল্টে ফেলে এসেছেন কি সাংঘাতিক! উনি এক্সিডেন্ট করেননি? ইয়া আল্লাহ্! আমি তাড়াহুড়ো করে উনার কপালের উপর চুল সরিয়ে চেক করছি কোথাও কেটেছে কিনা। কোমরে উনার হাত অনুভব করলাম। আমি চমকে উঠে থমকে গিয়ে উনার চোখের দিকে তাকালে উনি মুগ্ধ গলায় বলে উঠেন,
– আমি এক্সিডেন্ট করিনি পূর্ণতা। ব্যথা পাইনি।
পূর্ণতা টুপ করে পূর্বের পাপড়িভরা চোখে চুমু দিতে থাকে। ঝড়ের বেগে উত্তেজনাপূর্ণে বিহ্বল হয়ে পূর্ব পূর্ণতার কোমর চেপে ধরে। পূর্ণতার স্পর্শে মাতাল হচ্ছে এখন! মেয়েটা আমায় জ্বালিয়ে মারছে! শিট! আমি একবার যদি নিয়ন্ত্রণ হারাই পূর্ণ ইউ উইল বি গন!!পূর্ব চোখ খিচ মেরে বিড়বিড় করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,
– প্লিজ প্লিজ… ছাড়ো পূর্ণ, ছাড়ো। আমি ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলবো। পূর্ণ আমার!! প্লিজ প্লিজ..
পূর্ণতা পূর্বের কীর্তিতে খিলখিল করে অট্টহাসিতে হাসতে থাকে।ঠিক দম বন্ধ করা টাইপ খিলখিল হাসি!! হাসতে হাসতেই পূর্ণতা বহুকষ্টে হাসি চেপেচুপে বলে উঠে,
– আপনার ভীতু চেহারাটা দেখতে কিন্তু দারুন লাগছে পূর্ব!! আরেকটু জ্বালাই???
– ‘ চলবে ‘…………………
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
#FABIYAH_MOMO
( নোটবার্তা : গতকাল গল্প দিতে পারিনি তার কারন, ভুতুড়ে কান্ডের মতো দেখি নেটপ্যাক শেষ। মানে তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে আমি যে বাইরে বেরিয়ে রিচার্জ করবো উপায় নেই। একদিন অপেক্ষা করালাম তাই একটা গুড নিউজ আছে!! আগামীকাল গল্প দিবো। আজকের পার্টে কি লিখেছি না লিখেছি দুঃখিত। আগামী পার্টে সব পুষিয়ে দিবো। শ্রদ্ধাময় ভালোবাসা!! )
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক