#ফাবিয়াহ্_মমো
( ৫০.)
ক্যালেন্ডারের দিনগুলোতে চার মাস কাটা পরলো। শ্রেয়ার মৃত্যু এখন আর কাউকে নাড়িয়ে বেড়ায় না। সবাই যার যার ব্যক্তিজীবন ও পারিপার্শ্বিক কার্যকলাপ নিয়ে ব্যস্ত।পূর্ণতা সেই বাঙলো বাড়িতেই যৌথ পরিবারবিহীন সময় কাটাতে অভ্যস্ত হলো। এখন সে পড়াশোনা নিয়ে ভীষন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সামনেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা আসছে। আয়মানের সাথে ভার্সিটিতে যথেষ্ট উদগ্রীব হয়েই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে। যদিও আয়মান ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের তবুও পূর্ণতার পড়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমানের প্রমাণ দেয়। আয়মান এখন আর আগের মতো নেই। জীবনের আখের গুছাতে সে খুবই বিহ্বল। বাবা-মায়ের দেখাশোনা করার জন্য হলেও সে দায়িত্ববান হতে চায়। কিন্তু বিয়ে সে করবেনা বলেই পণ করেছে সবার সামনে। মানুষটা আগের মতো হাসি দিয়ে কথা বলেনা, আড্ডার জন্য তাড়া দেয়না, কোনোকিছু নিয়ে আর্কষণ বোধ করেনা। কেমন নিশ্চল, শূণ্য, অসাড় ভঙ্গিতে ব্যবহার করে!! পূর্ণতা এখন সবকিছুই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। আয়মান সকলের সাথে আর যাই করুক, পূর্ণতার সাথে ভিন্ন আচরণ করতে পারেনা। মাঝেমাঝেই পূর্ণতার বাঙলো বাড়িতে এসে চায়ের আড্ডা দিয়ে যায়। এতে পূর্ণতার একাকী সময়গুলোও বেশ জমিয়ে কাটে।
খোদেজা মেয়ের আলাদা থাকার খবর পেয়েছেন কিছুদিন আগে। এবং সেটা পেয়েই উনি আবার আগের মতো চটে গিয়েছেন পূর্বের উপর। পূর্বকে নিয়ে যতোটুকু মন নরম হয়েছিলো তা যেনো কঠিনীভূত হয়ে গেছে আবার। দুচোখে আর সহ্য করতে পারেন না পূর্বের সিদ্ধান্ত শুনে। শ্বশুরবাড়িতে গোজামিল হচ্ছে, কিন্তু তার জন্য শ্বশুর-শ্বাশুড়ির স্নেহ থেকে পূর্ণতা কেনো বন্ঞ্চিত হবে? ঠিক এটাই উনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ফুয়াদের ব্যাপারটা পূর্বিকার কাছ থেকে জানার পর পূর্বের চাচাদের কাউকে উনি সম্মানের নজরে দেখেন না। এ নিয়ে পূর্বকে কটাক্ষ করতে একচুল ভাবেনি খোদেজা। যার চাচারা আয়েশী ভঙ্গিতে ওয়াসিফ ভিলার মজা লুটছেন, পূর্ব কেনো তাদের শায়েস্তা করলো না? অবশ্য এ নিয়েও বাঙলো বাড়ির ঠিকানা পেয়ে পূর্বকে ঝেড়ে গিয়েছেন খোদেজা। সেদিন পূর্ব পার্টির অফিস থেকে একটু জলদি ফিরেছিলো কিন্তু শ্বাশুড়ির ঘ্যানঘ্যানানিতে চুপ থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করেনি সে। পূর্ণতা মা-কে কয়েকবার বাধা দিলেও পূর্বের কড়া চাহনির দিকে তাকিয়ে সেও মা-কে আর বাধা দেওয়ার সাহস দেখায়নি।
সকাল থেকেই বিষাদে শরীর গুলিয়ে উঠছিলো পূর্ণতার। পূর্ব সবসময়ের মতো ওকে না জাগিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আজ বিছানা থেকে উঠতেও পূর্ণতার মাথা ঘুরাচ্ছে। শরীর এতো ভারাক্রান্ত ও দূর্বল লাগছে যেটা আগে কখনো অনুভূত হয়নি। বড় জানালার দিকে চোখ ফেলল পূর্ণতা। বিশাল বড় জানালার কাঁচ ভেদ করে সকালের নরম সূর্যের তেজটা সাদা বেডটার উপর বাঁকা হয়ে পরছে। অনুমান করলো এখন হয়তো নয়টা বাজে। বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসলো পূর্ণতা। দুহাতে মাথা চেপে নিচের দিকে নুয়ে রইলো সে। মাথাটাও বড্ড ঝিমঝিম করছে। পূর্ণতা একবার ভাবলো পূর্বকে কল দিয়ে শরীর খারাপের কথাটা জানাবে। এরপরই সেটা বাতিল করে সে কাথা সরিয়ে পা দুটো ফ্লোরে রাখলো। সোজা হয়ে দাড়িয়ে পরতেই আবার বসে পরলো বিছানায়। না…বড্ড অসহ্য অনুভব হচ্ছে। এমনটা হওয়ার কথা না। বহুকষ্টে সে মোবাইলটা কাছে টানলো। ডায়ালে কল বসানোর আগে অনেকবার ভেবে নিলো কল করবে কিনা। তারপর সব নস্যাৎ করে সে কল করেই ফেললো।
– হ্যালো..
ওপাশটা থেকে মেয়েলি গলার উত্তর এলো,
– হ্যালো পূর্ণতা? কি ব্যাপার? তুমি সুস্থ? ভয়েস এতো লো শোনাচ্ছে কেন?
পূর্ণতা চিন্তা করলো সত্যিটা বলবেনা। কিন্তু না বলা ছাড়াও উপায় নেই। কমরেড বলা মানুষটা যে আজও তার ফোন রিসিভ করবেনা সে সম্বন্ধে সে জানে।
– আপু আমার খুব খারাপ লাগছে। বুঝতে পারছিনা কি হলো, কিন্তু সকাল থেকেই গা গুলানো ভাব।
ওপাশ থেকে পূর্বিকা যেনো কিছুক্ষন ভাবলো। এরপর সহজ গলায় বললো,
– বাইরের জাঙ্কফুড খেয়েছিলে?
– এ তো অসম্ভব আপু। উনি আমাকে ভুলেও ওসব খেতে দেন না।
– তাহলে কেস যে অন্যটা!! আচ্ছা আমি আসছি কেমন? তুমি দেখো তো, স্যালাইন আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে একটা ছিড়ে গুলে খাও। আমি আসছি।
– আচ্ছা আপু।
পূর্ণতা কল কেটে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। হাতের ফোনটা বিছানায় রেখে বমির ঢেকুর উঠতেই আচমকা চোখ খুলে তাকালো পূর্ণতা। ওমনেই দৌড়ে সে বাথরুমের দরজা লাগালো।
.
ডানপন্থীদলের কিছু নেতার সামনে গোলমিটিংয়ে বসেছে পূর্ব। চারজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং নামকরা সমাজসেবকদের পাশেই বসেছে সে। সবাই ওর বাবার বয়সী। ড. মাসুদ আলমগীর, ইমতিয়াজ উদ্দিন, সাইফুল খন্দকার ও বাশার মল্লিক। চারজনের সামনেই চার কাপ চা রাখা। মাসুদ আলমগীর অনেকক্ষন যাবৎ নানা খাতে কিভাবে টাকা লাগবে এ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পূর্ব যেহেতু এ দল থেকে আগামী ইলেকশনে এমপি রূপে দাড়াবে সেটা সকলের জানা ছিলো। তাই নিজেদের মধ্যে দুজন এমপি হয়েও পূর্বের সামনে এসব ব্যাপারে আলোচনা করতে সমস্যা হচ্ছিলো না। হঠাৎ সাইফুল খন্দকার তার খশখশে গলায় বলে উঠলেন,
– বন্যার পরিস্থিতি তো খুব খারাপ যাচ্ছে। সরকার বাজেট যে কবে পাশ করে, বুঝতে পারছিনা।
নেহায়েত স্বাভাবিক আলাপের মতো কথাটা বললেও খুব আশ্চর্য লাগলো পূর্বের। কিন্তু কৌতুহল সে চেপে রাখলো। নিজেরা সমাজসেবক হয়েও সরকারের দিকে কেনো তাকিয়ে আছে, মানেটা বুঝলো না। তাদের নিজেদের যা ব্যাংক ব্যালেন্স ও ব্যবসা আছে তাতে অনায়াসে অনেকগুলো মানুষকে এক্ষুনি সাহায্য করা সম্ভব। এবং সাহায্যটা এই মূহুর্তেই জরুরি। মাসুদ আলমগীর চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
– খুব তাড়া দেখছি আপনার। আপনি অঙ্কের হিসাবটা রিপোর্টে একটু বেশি দেখিয়েছেন বোধহয়। তাই হয়তো দেরি হচ্ছে পাশ করাতে।
গোল মুখ। সাদা শার্টের বোতাম ভেদ করে পেটের ভুড়ি যেনো বেরিয়ে আসতে চাইছে, মাথায় টাক। প্যান্টের অবস্থাও ভুড়ির জন্য শোচনীয় বাশার সাহেবের। আপাতত রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি হাসি দিয়ে বললেন,
– আপনারা ভাই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন। সরকার দেশের জন্য টাকা বরাদ্দ রেখে পাশ করাতে দেরি করছে কেনো? টাকাটা এখুনি বন্যাকবলিত অন্ঞ্চলের জন্য দরকার। টিভিতে প্রতিদিনই এই মন্ত্রী-সেই মন্ত্রী সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অথচ ভেতরের খবর কেউ রাখছে?
এবার মুখ খুললেন ইমতিয়াজ উদ্দিন। পার্টি থেকে আগামী ইলেকশনে পূর্বের জায়গায় সে নিজে দাড়াতে চাইছে। কিন্তু পূর্বের ইমেজ সৎ দেখে পার্টির সামনে নিজের ক্যান্ডিডেট নিয়ে জোর দিতে পারছেন না।। উনি মেহেদী দেওয়া লাল দাড়ি বুলাতে বুলাতে বিদ্রুপের সুরে বললেন,
– পার্টি যদি আমাকে টিকিটটা দিতো তাহলে বেশ ভালোই হতো। অন্তত তাড়াতাড়ি কিছু করার মতো তাগাদা দিতে পারতাম। আমার আবার উপরওয়ালার সাথে খাতির আছে।
পূর্ব চুপচাপ চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে দুই কনুই চেয়ারের হাতলে ঠেকিয়ে দশ আঙ্গুল আবদ্ধ করে বসে আছে। চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ম এবং মুখের আদল বেশ গম্ভীর। পূর্বকে চুপচাপ থাকতে দেখে চৈতন্য পাওয়ার মতো ফিরে তাকালেন মাসুদ আলমগীর। পূর্বের ব্যাপারে যতটুকু তথ্য সে জেনেছে তাতে কোথাও অন্যায় সহ্য করার পরিচয় সে পায়নি। এদিকে ইমতিয়াজ উদ্দিন বারবার যে পূর্বকে ট্যাকেল দেওয়ার ধান্দায় আছেন সে সম্বন্ধেও তার জানা। তিনি কিছুটা ধাতস্থ গলায় বললেন,
– ওয়াসিফ পূর্ব কি আমাদের আলোচনায় বিরক্ত ?
পূর্ব এবার হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– না, জনাব। আমি অবশ্যই এখানে বিরক্ত হতে আসিনি। আপনাদের আলোচনা থেকে কিছু শিখতে এসেছি এবং শেখার জন্যেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
– একটা কথা বলার ছিলো বুঝলে?
– জ্বি অবশ্যই।
মাসুদ আলমগীর পূর্বের উত্তর শুনে কেমন অদ্ভুত হাসি দিলেন। এরপর বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে চোখে-চোখে কিছু একটা ইশারা করে পূর্বের দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। পূর্ব একটু অবাক হলেও বিয়ষটা সহজভাবে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলো।
– পার্টি থেকে যে এখুনি তুমি ক্যান্ডিডেট হিসেবে দাড়াতে চাচ্ছো, এতে কোনো সাহায্য লাগলে আমাকে বলতে পারো।
পূর্ব ভ্রুঁ দুটো কুঁচকাতে যেয়েও কুঁচকালো না। কয়েক মিনিটের নিরবতায় সে ভেতরে কিছু সমীকরণ তৈরি করে গুছানো বার্তায় বললো,
– ইলেকশনে দাড়াতে খোদ পার্টি আমাকে সাপোর্ট দিচ্ছে। আর জনগণের উপর আমার আস্থা আছে তারা আমাকে অবশ্যই ভোট দিবে। আমার অর্থনৈতিক দিকেও কোনো ঘাটা নেই। আমার মনেহয়না আলাদা কোনো সহযোগিতা আমার দরকার। তবুও যেহেতু বলেছেন তাই আপনাকে ধন্যবাদ।
পূর্বের কথা শুনে ব্যাঙ্গস্বরূপ হাসি দিলেন মাসুদ আলমগীর। হাসতে হাসতে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। বাকি তিনজনের মুখেও সংক্রামকের মতো হাসি লেপ্টে রয়েছে। কিন্তু পূর্ব এটা বুঝতে পারছিলো না, তারা কেনো সাহায্য করতে চাইছে? রাজনীতিতে সবাই স্বার্থপরের মতো হয়। যেখানে ফায়দা লুটা শেষ সেখানে মালপত্র গুটিয়ে নেওয়াটাই ওদের ধর্ম। এখানে নব্য রাজনীতিবিদ হিসেবে ওকে নিঃস্বার্থে সাহায্য করবে এটার কোনো মানেই হয়না। মাসুদ আলমগীর হাসি থামিয়ে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে আঙ্গুলগুলো আবদ্ধ করে বলে উঠলেন,
– একটা কথা সোজাসুজি বলি? আর ঘুরপ্যাঁচ সহ্য হচ্ছেনা। আসলে ইমতিয়াজ সাহেব চাচ্ছেন তুমি আপাতত টিকিটটা ছেড়ে দাও। মেয়রের কৌঠায় তো শূন্য চলছে। তোমাকে নাহয় বলে কয়ে ওই কৌঠার টিকিট ম্যানেজ করে দিলাম।
পূর্ব এতোক্ষনে পুরো ব্যাপারটা স্বচ্ছ পানির পানির মতো বুঝতে পারলো। আপন মনে কিছুক্ষন হেসে মাসুদ আলমগীরকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি এমপি পদের কৌঠাটা কেনো ছেড়ে দিতে বলছেন? বিশেষ কারন কি?
এবার উত্তরটা তিনজনের মধ্যে থেকে একজন দিয়ে বসলো। পূর্ব বামে তাকিয়ে দেখলো সাইফুল খন্দকার শান্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর পেশ করছে,
– দেখো পূর্ব, তুমি রাজনীতিতে এসেছো বেশিদিন হয়নি। তার উপর এমপি পদে ইলেকশনে দাড়ানোটা একদম বোকামি। তোমার চেয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ জ্ঞান রাখেন ইমতিমাজ সাহেব। ধরো, চলতে চলতে কোনো এক বিরাট ভুল করে ফেললে সেক্ষেত্রে একজনের জন্য কিন্তু পুরো পার্টির নাম খারাপ হবে। এর মধ্যে মিডিয়ার রঙচঙ মাখানো ব্রেকিং নিউজ তো আছেই। জনগণ ভড়কে গিয়ে উল্টো পার্টিকেই দোষারোপ করবে।
কথাশুনে নিজের উত্তরও পেশ করলো পূর্ব,
– আমি তরুণ বলে আমাকে পিছিয়ে যেতে বলছেন? দেখুন, আমার বয়স কিন্তু থার্টি। নিজের বয়স ও বিবেক চিন্তা করলে অবশ্যই এমপি পদে দাড়ানোটা আমি উপযুক্ত মনে করি। দেশের সংবিধানে এটা কোথাও বলা নেই, তরুণ সমাজ থেকে এমপি পদে দাড়ানো যাবেনা। বরন্ঞ্চ তরুণদের আগে থেকে এজন্য উৎসাহ দেওয়া হয় তারা যেনো আগামী দিনের হাল ধরুক। আমি মেয়র পদে প্রার্থী হতে চাইনা। আমার লক্ষ্য সবসময় এমপি পদের দিকেই ছিলো আর আমি সেটাই পছন্দ করবো।
পূর্বের কাটকাট জবাব শুনে প্রচণ্ড উত্তেজিত হলেন ইমতিয়াজ সাহেব। তিনি বাকি তিনজনের উপস্থিতি উপেক্ষা করে পূর্বকে জোর গলায় বললেন,
– তোমার চেয়ে দলে আমি বেশি অবদান রেখেছি। আমার কি এটা প্রাপ্য না? তাছাড়া তুমি পরেও তো প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারো। কেনো এখন তর্ক লাগাচ্ছো?
– সুযোগে কোপ মারাই নৈতিক ধর্ম ইমতিয়াজ সাহেব। আমি এতোগুলো বছর শুধু রাজনীতির পেছনেই খেটেছি। অবশ্যই আমার অভিজ্ঞতা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না?
– সে কথা তো কেউ বলছেনা। তুমি এখন বাড়াবাড়ি করছো সেটাই তোমাকে বোঝানো হচ্ছে। তুমি শুধু পার্টির কাছে দরখাস্ত করো, এবছরের প্রার্থী হিসেবে দলের হয়ে তুমি দাড়াতে ইচ্ছুক নও।
– সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার! তাছাড়া আমি তো সুযোগ ছাড়বো না। আপনি আমাকে ভালো করে চিনে থাকলে এটুকু অবশ্যই জেনে গিয়েছেন, ওয়াসিফ পূর্ব দ্বিমুখো সিদ্ধান্তের মানুষ না। যা বলেছি তাই করবো! আগামী ইলেকশনে আমিই দাড়াবো। পার্টি যদি নিজ থেকে আমাকে সরাতে চায় সেটা আমি মানতে প্রস্তুত। কিন্তু অন্যের কথায় সিদ্ধান্ত বদলাবো না।
পূর্ব আর একটা কথা ওদের সামনে ব্যয় করলো না। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায় নেমে এলো। ড্রাইভার গাড়ির দরজার সাথে ঠেস দিয়ে কোক খাচ্ছিলো, পূর্বকে দেখে তাড়াতাড়ি সেটা বন্ধ করে জানালা দিয়ে রেখে দিলো। পূর্ব আজকের মতো এতো রাগান্বিত বোধ আগে কখনো করেনি। বেহিসেবী কথাও সহজে বলেছে কিনা সন্দেহ কিন্তু আজ প্রচণ্ড রাগের বশেই লোকটাকে অনেকগুলো কথা শোনালো। মাথার ভেতর দপদপ করছে পূর্বের। একটা কিছু ভাঙচুর করতে পারলে শান্তি লাগতো। কটকটে রোদের মধ্যে সাদা পান্জাবী প্রায় ভিজে উঠছে। মুখের মধ্যে মাস্ক লাগানো না থাকলে ড্রাইভার সেই চেহারা দেখেই ভয় পেতো। শুধু চোখদুটো দেখে যা বুঝলো পূর্বকে ঘাটালে গেলেই এখন মহাবিপদ হবে। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে পূর্ব গাড়িতে উঠে পরে। গাড়ি চলতে শুরু হলে মুখের মাস্ক খুলে সিটে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা পিছনে হেলিয়ে দেয় পূর্ব। সকাল থেকে এক ঢোক পানিও খায়নি সে। শরীর এখন অজান্তেই ক্লান্তিপূর্ণ এবং নিসাড়। হঠাৎ সামনের সিট থেকে ড্রাইভার প্রশ্ন করলো,
– বস? বাসায় যাইবেন? গাড়ি ওইদিকে ঘুরামু?
পূর্ব ক্লান্ত গলায় চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় বললো,
– ওয়াসিফ ইন্ড্রাস্টিজে চলো। প্রচুর কাজ…প্রচুর কাজ পরে আছে।
বলতে বলতেই শরীর ছেড়ে দিলো পূর্বের। দুচোখের পাতায় আসক্তিময় ঘুম ঘিরে ধরেছে। পূর্ণতাকে ঘুম পারিয়ে বাবার ব্যবসার কাজে সারা রাত নির্ঘুমে কাটাতে হয় পূর্বের। দুই চাচাও এখন হাত গুটিয়ে নিয়েছে বাবার ব্যবসা থেকে। পলাশ ওয়াসিফের নাম করে বৃহৎ অঙ্কের লোনও নিয়েছে পরশ ও পলক ওয়াসিফ। পলাশ এ সম্বন্ধে এখনো কিছু জানেনা। পূর্ব যখন জানতে পেরেছে চাচারা লোন দিয়ে নিজেদের ব্যবসা গুছাচ্ছে তখন দিনরাত এক করে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়েছে পূর্ব। শরীরে এখন বিন্দুমাত্র রেস্ট ব্যাপারটা কাজ করেনা। সারাদিন পার্টির কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে পূর্ণতাকে সময় দিতে হয়। পূর্ণতা ঘুমাতে দেরি, সেও নিঃশব্দে বাবার ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিতে দেরি করেনা। পূর্ণতাকে এখনো ঘোরের মধ্যে রেখেছে পূর্ব। বাবার ব্যবসায় যখন লালবাতি হয় তখন যে রঙধনুর সাত বাতি জ্বালাতে পূর্ব অমানুষিক পরিশ্রম করে সে খবর পূর্ণতা চোখে দেখার সুযোগ পায়নি এখনো। পলাশের শারীরিক অবস্থা দিনদিন ফুয়াদের মতো হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পূর্ব বাড়ি ছাড়ার পর থেকে আরো বেহাল হয়ে গিয়েছেন। আয়েশা মনমরা হয়ে সারাদিন স্বামীর পাশে থাকলেও মন পরে থাকে একমাত্র ছেলের দিকে। পূর্বের চাচী আফরিন ও শেফালী দেদারসে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এখন এ বাড়িতে কেউ তাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য নেই। মিথুন স্বস্তিভাবে বাঁচার জন্য কানাডায় পড়াশোনা করতে চলে গেছে। মোটকথা, শূন্য খাঁ খাঁ করে ওয়াসিফ বাড়ি।
.
বিকেল তিনটে। ঝাঁঝালো রোদের তেজ নরম হতে শুরু করেছে। দূর থেকে কোকিল যেনো থেমে থেমে ডেকে উঠছে। গাছের ডালপালা নড়ার চান্ঞ্চল্যকর শব্দ আচমকা শোনা যাচ্ছে। পরিবেশ এখন শান্ত। বিছানায় আসন করে কোলে বালিশ রেখে বসে আছে পূর্বিকা। পিঠটা বড় জানালার সাথে ঠেস দিয়ে রেখেছে। কোলের বালিশটায় পূর্ণতার মাথা রাখা। পূর্বিকা হাতের স্পর্শ দিয়ে পৃর্ণতার চুলের চামড়ায় দারুন ম্যাসাজ দিচ্ছে। পূর্ণতা বড্ড শান্তিতে চোখ বন্ধ করে আছে। অনেকক্ষন পর পূর্বিকা অন্যমনষ্ক গলায় বললো,
– আমি খবরটা দেই?
পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে বললো,
– না আপু, দোহাই! এখুনি বলো না। উনি আসুক।
সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার চেতনায় মাথা মৃদ্যু ঝাকি দিয়ে পূর্বিকা সরাসরি পূর্ণতার দিকে তাকালো। মুখটা পানসে লাগছে পূর্ণতার। গলার হাড়ও দেখা যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া যে ঠিকমতো করেনা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পূর্বিকা অভয়বাণীতে বললো,
– আচ্ছা বলবো না। কিন্তু খাওয়াদাওয়া কি বাদ দিয়েছো? ওই বজ্জাত তোমাকে বকে না?
– বকে না আবার? পারেনা তুলে আছাড় মারে। রাগ করেছে জাহাপনা। আমি কথা মানিনা দেখে এক সপ্তাহ ধরে কোনো কথাবার্তা নেই।
– কি আশ্চর্য! ও তোমার সাথে এসব করে বেড়াচ্ছে? আজ ও আসুক! যদি ওকে ছোট থাকতেই থাপ্পরে রাখতাম আজ তোমার এইদিন দেখতে হতো না।
– রাগটা কি ছোট থেকেই ছিলো?
– অতিরিক্ত ছিলো। কিন্তু বড় হওয়ার পর ধরন পাল্টে গিয়েছে। আগে কিছু হলেই সব ভাঙচুর করে ফেলতো। আর এখন একদম চুপচাপ হয়ে কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়। ফাজিল কোথাকার!
– থাক আপু শান্ত হও। কিচ্ছু বলতে হবেনা। তুমি যে এসেছো এতেই আমি খুশি। আর কিচ্ছু করতে হবেনা।
– পূর্ণতা তুমি কি আমায় পর ভাবো? দেখো আমি সত্যিই তোমার খারাপ চাইনা। সেদিন চাচী যখন তোমাকে নিয়ে ফালতু কথা বলছিলো আমি চাইতেও কিছু বলতে পারছিলাম না। আমি কেনো জানি পূর্বের মতো চটে উঠতে পারিনা। ওর যেই তেজ, যেই রাগ সেগুলো আমার মধ্যে কম আছে। আমি…
– থামো আপু, এভাবে বলো না। তুমি মেয়ে মানুষ। প্রতিটি মেয়েই ওই সিচুয়েশনে কি করবে ভেবে পায়না। তার উপর তুমি খুব ঝামেলামুক্ত মানুষ। ওগুলো তো সহ্য করার অবস্থাও তোমার নেই।
– আমি তো বড়। আমার তো একটু হলেও সাপোর্ট দেওয়া উচিত ছিলো। সেদিন পূর্ব এতো কঠিন করে বললো যে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিলো।
পূর্ণতা এখন কিছুই ভাবতে পারছিলো না। খুশির সংবাদটা শুনে পূর্বের প্রতিক্রিয়া কি হবে এ নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিলো। যদি পূর্ব রাগের মাথায় সেন্সিটিভ কিছু বলে ফেলে তাহলে কি পূর্ণতা সহ্য করতে পারবে? এতোদিন করতে পারলেও এখন সে পারবেনা। তার মন বদলাচ্ছে, আবেগ ঘন হচ্ছে। পূর্বের রাগারাগী সে মেনে নিতে পারবেনা। সময় কাটতে কাটতে সন্ধ্যার আধার শেষে অন্ধকারময় রাত্রি নামলো। পূর্বিকা অসুস্থ বাবার জন্য না চাইলেও পূর্ণতাকে রেখে যেতে বাধ্য হলো। গাড়ি নিয়ে এসেছিলো পূর্বিকা, সেই গাড়িতেই বিদায় জানিয়ে ফিরে গেলো। বাঙলোর সামনের দিকটায় মাটির উপর সবুজ ঘাসের সমাহার। কয়েক জায়গায় গাড়ির টায়ারের ছাপ। বাইরে হলুদ বাতি ছাড়া অন্য কোনো বাতি জ্বালাতে দেয়না পূর্ব। পূর্ণতা পা ঘুরিয়ে বাঙলোর ভেতরে ঢুকে শোয়ার কক্ষে ফিরে এলো। পায়ে পায়ে বেডের কাছে আসতেই ধপ করে বসে পরলো। বিয়ের এক বছর পূর্তি হলেও কোথাও ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি নেই। নির্জন রাস্তায় আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল মিলিয়ে হাঁটার সুখ পায়নি। রিকশায় চড়ে শহর দেখার অনুভূতি হয়নি। সবসময় বদ্ধ জীবনে থেকেই তার বিয়েটা ব্রত হিসেবে চলছে। পূর্ব বিয়ের পর চুটিয়ে প্রেম করতে পারেনি। সে তার রাজনৈতিক কাজ নিয়ে আরো দ্বিগুণ ব্যস্ত হয়েছে। আজও মানুষ জানেনা পূর্ণতা কবির কে, বা কি তার পরিচয়। পূর্ব যদি পাবলিকের সামনে তাকে বউ হিসেবে অস্বীকারও করে সেটা সবাই বিশ্বাস করে নেবে। কেননা, পূর্বের স্ত্রী বা সহধর্মিনীকে কেউ কখনো দেখেনি। এসব ভাবতে ভাবতে অজানা কারনে পূর্ণতার চক্ষুকোল ভিজে উঠছিলো। যদি পূর্ব কখনো বদলে যায়? যদি তাকে অস্বীকার করে ভোগবস্তু হিসেবে ছুঁড়ে ফেলে? যদি কখনো মন উঠে যায় ওর উপর থেকে?
পূর্ণতা নিজের অশান্ত মনকে অগ্রাহ্য করার জন্য ফোন হাতে নিলো। একহাতে কললিস্টে স্ক্রল কর অপরহাতের উলটোপিঠে চোখ মুছলো। আয়মানের নাম্বারে কল দিয়ে গলা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করলো।
– কিরে? ঘটনা কি? তুই এমন বেটাইমে কল দিলি কেন?
– কেন? আমি কল দিলে সমস্যা?
– হুর ছেড়ি! আমি কি ওইডা মিন করছি? বল কি খবর তোর? সকালে তো ভার্সিটি আসলি না।
– বন্ধু তুই কি আর বিয়ে করবি না?
– বাল কও তুমি? শালা মেজাজটা নষ্ট কইরা দিলি।
– পাকনামো না করে বলতো,
– না করতাম না। জীবনেও করতাম না।
– কেন? আমার বাড়িতে জামাই পাঠাবি না? তুই না আমার হবু বেয়াইন?
ওপাশ থেকে আয়মান যেনো হাসলো। হাসিটা অল্পক্ষণ হতেই উদাস কন্ঠে বলে উঠলো,
– জীবনে সুখ থাকলে সুখী হওয়ার চিন্তা থাকে। আমি আর ওসব নিয়ে ভাবতে পারিনা পূর্ণতা। নিজেকে চেন্জ করতে চাচ্ছি।
পূর্ণতা খেয়াল করলো আয়মান আবার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। শ্রেয়ার ওই বিশ্রী ঘটনা জানার পর থেকে অলৌকিকভাবে পরিবর্তন ঘটে আয়মানের। সে আর পুরোনো গলায়, পুরোনো সুরে কথা বলেনা। মাঝেমাঝে বললেও সেটা ঠিক করে নেয়। পূর্ণতা অনেক ভেবেচিন্তে বলে উঠলো,
– দোস্ত আমি প্রেগনেন্ট।
– ওহ্।
আয়মান এমন ভাবে বললো যেনো নরমাল কোনো কথা বলেছে পূর্ণতা। এরপর হুঁশ ফেরার মতো চোখ বড় করে বসা থেকে ধাপ করে উঠেই এক চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– তুই প্রেগনেন্ট !
আয়মানের চিৎকারে কানের পাতা যেনো চিলিক দিয়ে উঠলো পূর্ণতার! তাড়াতাড়ি ফোন সরিয়ে অন্যকানে ধরে বিরক্তির সুরে বললো পূর্ণতা,
– তুই আসলেই একটা ইবলিশ! শ্রেয়া তোকে মিছেমিছি ইবলিশ বলতো না! কি চিৎকারটা দিলি! উফ!
আয়মান এখনো থতমত। কোনো ভাষা নেই, শব্দ নেই, একদম বাকবুদ্ধিহীন ব্যক্তি। পূর্ণতা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
– দোস্ত? হ্যালো? আয়মান? কিরে শুনতে পাচ্ছিস?
কয়েকসেকেন্ড নিঃশব্দে কেটে যেতেই হঠাৎ আয়মান ফোন কেটে দিলো। পূর্ণতা পুরো আহাম্মকের মতো স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিলো। আয়মান কিছু বললো না? এরপরই ফোনে নতুন মেসেজের আগমন দেখলো,
– ‘ মিষ্টি খাবো পূর্ণতা। কালকে আসছি ‘
.
রাত সাড়ে দশটা বাজতেই বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ হলো। পূর্ণতা ব্যালকেনির ডিভানে শুয়ে মুখের উপর ম্যাগাজিন ধরে আছে। পূর্বের আগমন বুঝেও কোনো হেলদোল নেই ওর। পূর্ব চুপচাপ কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকবে, ফ্রেশ হয়ে বাসি পোশাক একতলার ছাদের দিয়ে আসবে, এরপর খেয়েদেয়ে নিজের মতো শুয়ে পরবে। এ নিয়মের বাইরে যদি রুটিন হয় তাহলে পূর্ণতাকে জোর করে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরবে। আজ পূর্ব বড্ড ক্লান্ত অনুভব করছে। টেবিলের উপর ওয়ালেট, মোবাইল, মাস্ক, ইয়ারপড সব রেখে ব্যালকনির দিকে উঁকি দেয়। পূর্ণতাকে ডিভানে দেখে আবার রুমে ফিরে গায়ের শার্ট খুলে ওয়াশরুমে চলে যায়। পরিস্কার হয়ে ফিরেই পাশের রুমে খাওয়াপর্ব সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় পূর্ব। বিছানায় শোয়ার আওয়াজ পেতেই চট করে ম্যাগাজিন বন্ধ করে পূর্ণতা। গুটিগুটি পায়ে বিছানার পাশে দাড়িয়ে চিন্তা করে কি করবে। পূর্বকে ডাক দিবে? আচ্ছা আজই কি বলতে হবে? কাল বললে হয়না? নানা উদ্ভট চিন্তার রেশে বিপাকে ফাঁসতেই চোখ বন্ধ করা অবস্থায় গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো পূর্ব,
– কোনো জরুরি ব্যাপারে বলার থাকলে বলো। নয়তো শুয়ে পরো। এভাবে খাম্বার মতো সামনে দাড়িয়ে থাকার মানে হয়না।
পূর্ণতা হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিলো। পূর্বের সামনে ভড়কে যাওয়া চলবেনা। সে পূর্বের দিকে কঠোর ভঙ্গিতে বললো,
– তুমি কতদিন রাগ চেপে বসে থাকবে? কথা বলবে না?
– কিসের কথা? কি নিয়ে কথা বলবো? কে আমি? আমি তোমার কেউ?
– এগুলো কি বলছো? তুমি আমার কেউ না? তুমি আমার সাথে কেনো মুখ ঘুরিয়ে কথা বলছো?
পূর্ব এবার চোখ খুলে মাথার নিয়ে হাত রেখে বললো,
– তুমি কি জানো না? নতুন করে বুঝানো লাগবে? তুমি কি নতুন কেউ?
– ওহ্, তাই বলো। আমি যে পুরোনো হয়ে গেছি সেটাই তো জানতাম না।
– বাজে বকো না পূর্ণ! আমার কথার উল্টো মিনিং খুজেঁ বের করো না।
– বাধ্য করছো!
– আমি আগেই বলেছি আমি তোমার কেউ না।
পূর্ণতা কি বলবে সেটা ক্ষোভের কারনে গুছাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলো। এতো রাগ উঠছিলো যে সব ছেড়েছুড়ে এখান থেকে চলে যেতো ইচ্ছে করছিলো। পূর্বের মুখ এখনো আগের মতোই গম্ভীর। তবে আগের তুলনায় খুব বেশি কঠোর ভাব ফুটে উঠেছে মুখে। পূর্ণতা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতেই বলে উঠলো,
– আমি কি এখান থেকে চলে যাবো?
– সেটা তোমার নিজস্ব ইচ্ছা।
– আমার থাকা না-থাকা কোনো মূল্য রাখেনা?
– আহ! কথা বাড়াবেনা! যাও বলছি! ইচ্ছে করলে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও!
পূর্ণতা শিউরে উঠেও পুরোদমে কান্না আটকে আলমারি খুলতে ব্যস্ত হলো। পূর্বের মাথায় এখনো ইমতিয়াজ উদ্দিনের বেহুদা কথার সারর্মমটা ঘুরঘুর করছে। পূর্ণতার উপর থেকে সমস্ত চিন্তাচেতনা যেনো হুট করেই উধাও হয়ে গেছে ওর। পূর্ব সাদা ব্লাঙ্কেট টেনে অন্যকাত হয়ে শুয়ে পরলো। তা দেখে পূর্ণতা এবার আটকে রাখা কান্নাটা সামলাতে পারলো না। ঠোঁট কামড়ে চোখের পানিতে গাল একাকার করে লাগেজ গুছিয়ে দরজার দিকে চলে গেলো। হাতের ফোনটা নিয়ে উবারে কল করে গাড়ির জন্য কনফার্ম করলো সে। লাগেজের হ্যান্ডেল আকড়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে সে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চললো। পূর্ণতা যতোবার চোখ মুছছিলো ততোবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছিলো, এইতো বুঝি পূর্ব ডেকে উঠবে। ওকে আটকাবে। যেতে দিবেনা। কিন্তু আফসোস! বাঙলোর কাছে কোনো মানবমূর্তি এসে দাড়ালো না। পূর্ণতা বড় রাস্তার দিকে চলে আসতেই আরেকবার পিছু ফিরে তাকালো। এবং মনেমনে জেদ চাপলো,যদি পূর্ব নিজ থেকে ওকে না ডাকে পূর্ণতা মনের ভুলেও ফিরে আসবেনা! আজ সে কিচ্ছুই সহ্য করবেনা নিজের সাথে! দিনদিন পূর্বের উগ্রপনার রাগ ধীরেধীরে পূর্ণতার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে দিচ্ছে! অনেক সহ্য করেছে সে! অনেক এবং সেটা অতি মাত্রায়!
নিস্তব্ধ পরিবেশে বামকাত হয়ে শুয়েছিলো পূর্ব। হঠাৎ কানে সত্যি সত্যি গাড়ির হর্ণ শুনতে পেয়ে ধড়াস করে ব্লাঙ্কেট ফেলে উঠে বসে পূর্ব। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতার কোনো অস্তিত্ব নেই! পূর্ণতা কোথাও নেই! আলমারির দ্বারও একটু খোলা। দরজা লক করা নেই। পূর্ব আর কিচ্ছু ভাবার সময় পায় না। হুড়মুড়িয়ে বের হয়ে দেখে ততোক্ষনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। উবার কারের দুটো হেডলাইট ছাড়া দূর থেকে আর কিচ্ছু দেখা সম্ভব হয়নি। মাথা চাপড়াতে গিয়ে পূর্ব আবার দৌড় দিলো বাঙলোর দিকে। টেবিলের কাছে হুড়মুড় করে আসতেই দরজার সাথে পায়ের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে মারাত্মক উষ্টা খেলো। ভীষন যন্ত্রণায় চোখ কুঁচকে এলেও খুড়িয়ে হেঁটে ফোনের কাছে পৌঁছলো পূর্ব।। ফোন কানে নিয়ে বিছানায় চোখ কুঁচকে বসলো। কনিষ্ঠ আঙ্গুল থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে পূর্ণতা ফোন ধরছেনা! একবার দুইবার বহুবার চেষ্টা চালানোর পর হঠাৎ ওর নজর আটকালো ঘড়ির দিকে! টিক-টিক-টিক করে ঘড়িতে পনে দশটা বাজছে! ধ্বক করে করলো পূর্বের বুকে! ধাম ধাম করে বুকের উপর কেউ চাবুক পেটাচ্ছে! এতো রাতে পূর্ণতা বেরিয়ে গেলো? রাস্তায় যদি কোনো সমস্যা হয়? কি করবে? এখন কি করা উচিত? পূর্ব তাড়াতাড়ি গাড়ির চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে কোনোরকমে দরজা লক করে বেরিয়ে পরলো। একপা-ও ঠিক করে ফেলতে পারছেনা পূর্ব। কনিষ্ঠ আঙ্গুলের নখটা উল্টে সেখান থেকে বেকায়দায় টপটপ রক্ত ঝরছে। ব্যথার মধ্যেই পায়ে লুপার পরে গাড়ি স্টার্ট দিলো পূর্ব। নিশ্চয়ই ও বেশিদূর যায়নি? আর গেলেও পূর্ণতাকে ফিরিয়ে আনা যাবে!
পূর্ব ব্যথা উপেক্ষা করে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ব্যস্ত। চোখেমুখে কাঠিন্য আভা ছেয়ে আছে। গাড়ির যেই স্পিড দিয়েছে তাতে একটার পর একটা গাড়ি শাই-শাই করে পাশ কাটাচ্ছে রকেটের মতো। বারবার ফোন করার পর কিছুক্ষন হলো পূর্ণতা ফোন বন্ধ করেছে। পূর্ব স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলো তার লুপার ভিজে স্যাতস্যাতে লাগছে। আর সেটা যে রক্তের কারনে তা বুঝতে বেশি টাইম লাগেনি। হঠাৎ কাঙ্ক্ষিত গাড়িটা দূর থেকে দেখতে পেলো পূর্ব। আরেকবার মনে মনে গাড়ির নাম্বারটা আওড়ে স্মৃরনশক্তির নাম্বারটার সাথে মিলিয়ে নিলো। দ্যাটস ইট! এটাই গাড়ি! এখনো কয়েক গজ দূরে আছে উবারটা। পূর্ব সেটা ওভারটেক করার জন্য যেই স্পিড বারিয়ে দেয় ওমনেই ওর ফোনটা বাজতে থাকে। পূর্ব স্পিড বাড়ানো অবস্থায়ই চট করে কল পিক করে। নাম্বারটা অজানা তবুও কলটা পিক করে কানে ধরে পূর্ব। ওমনেই ওপাশ থেকে খড়খড়ে গলায় কথা বলে উঠলো,
– ওয়াসিফ পূর্বের সাথে কথা বলছি?
– জ্বী, বলুন।
– আমি ইমতিয়াজ উদ্দিন।
অপ্রত্যাশিত কায়দায় সাথেসাথে ব্রেক কষলো পূর্ব। বুকের ভেতর যে ভয়গুলো গুটি পাকিয়ে ছিলো সেগুলো আস্তে আস্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পূর্ব কানে ফোন ধরে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সর্তক ভঙ্গিতে ডান থেকে বামে চোখ ঘুরালো। দুধারে সবুজ গাছগুলো রাতের অন্ধকারে ভূতুড়ে আকার ধারণ করেছে। পূর্বের ডানপাশ দিয়ে শো শো করে গাড়ি, ট্রাক, বাস ছুটে যাচ্ছে। শুস্ক গলায় ঢোক গিললো পূর্ব। এরপর তীক্ষ্ম গলায় বললো,
– কি চাই?
– পদটা ছেড়ে দাও। এর জন্যে যতো টাকা দরকার সেগুলো আমি তোমায় দিবো। তোমার বাবার নামে যে লোন রয়েছে সেগুলো পরিশোধ করতে আমি তোমায় সাহায্য করবো। তুমি শুধু পার্টিকে ‘না’ করে দাও। বলে দাও, এবারের ইলেকশনে তুমি দাড়াচ্ছো না।
পূর্ব থম মেরে চুপচাপ বসে আছে। এখনো স্টিয়ারিংয়ে হাত এবং কানে ফোন ধরা। চোখের সামনে থেকে পূর্ণতার গাড়িটা একটু একটু দূরে চলে যাচ্ছে। গলায় এখন ঢোক ফেলতেও প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। ডানদিকের জানালা দিয়ে লেফট মিররে নজর পরলো পূর্বের। একটা ‘লটো কার’ পূর্বের ঠিক পেছনে কয়েক হাত দূরত্ব রেখে দাড়িয়ে আছে। গাড়িটার ফ্রন্ট লাইটগুলো অন-অফ হচ্ছে। এই মূহুর্তে পূর্ণতার পেছনে ছুটা মানে ইচ্ছা করে ওর বিপদ ডাকা। পূর্ব চট করে সেখান থেকে চোখ সরিয়ে আবার সামনের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ উদ্দিন যতোটা শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলে.. স্বার্থ হাসিলের জন্য ঠিক ততোটাই ভয়াবহ কান্ড করে দেখাতে পারে। সে আবার বলে উঠলো,
– সিদ্ধান্ত আজ রাতের মধ্যে জানাও ওয়াসিফ পূর্ব। আমি তোমাকে আজ রাতটুকুই দিচ্ছি। যদি তুমি চাও তোমার পরিবার ভালো থাকুক, আমি যেভাবে বলি সেভাবে করো। পলাশ ওয়াসিফ অবশ্যই এখন আগের মতো সুস্থ না। বিষয়টা মাথায় রাখো।
ইমতিয়াজ কল কেটে দিলো। পূর্বের সমস্ত ইন্দ্রীয় যেনো আগুনের হুলকায় হুটোপুটি খাচ্ছে। হিসহিস করে নিশ্বাস ছাড়লেও চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে অটল হয়ে আছে। পূর্ণতার গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বেশ দূরে চলে যাচ্ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টিলব্ধ চোখদুটো। যতটুকু দেখা যাচ্ছিলো, ঝাপসার জন্য সেটুকুও দেখতে পেলো না পূর্ব। নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অসহায়, অপদার্থ ও অপরাধী লাগছে এখন! মরে গেলে শান্তি হতো না? কান থেকে ফোন ছেড়ে স্টিয়ারিংয়ে কপাল ঠেকিয়ে দিলো পূর্ব। আজ নিজেকেই সে চিনতে পারছেনা।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
( নোট : আজ সবার ছোটোখাটো প্রতিক্রিয়া শুনতে চাই। আমার অর্ধশত পর্ব অবশেষে পূর্ণ হলো। আলহামদুলিল্লাহ। )
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক