কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩
কোনো কিছু ভালো লাগছে না। কিসব হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না। এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে কে মা’র’তে পারে? মেয়েটা বড্ড মিশুক, যে কোন মানুষের সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারে। আশেপাশের সবাই ওকে খুব ভালোবাসে।
আল্লাহ এ সবকিছু স্বপ্ন হোক। কারো ডাকে ঘুম ভেঙে যাক। চোখ মেলে দেখি সবকিছু মিথ্যা! তিন্নি একদম সুস্থ আছে। হেসে হেসে কথা বলছে আমার সাথে। নিজের হাতে কয়েকবার চিমটি কাটলাম। না! এ স্বপ্ন নয়, বাস্তব! খুব ভ’য়া’ন’ক বাস্তব। স্বপ্নের থেকে বাস্তব খুব বেশি কঠিন হয়। ঘুম ভেঙে গেলে দুঃস্বপ্ন হারিয়ে যায়, কিন্তু বাস্তবে দুঃসময় খুব ধীরে কাটে।
তিন্নির বাবা একজন কৃষক। বাড়ি থেকে একটু দূরে তিন বিঘের মতো জমি আছে। সেখানে সারাবছর নানা রকম ফসল ফলায়। এলাকার লোকজনের সাথে কোন প্রকারের বিরোধ নেই তাঁর। জসিম কাকাকে কখনো কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখিনি। খুব শান্ত প্রকৃতির একজন মানুষ। বাড়িতে মানুষ বলতে তিন্নি আর কাকি মা। এছাড়া সাত কূলে কেউ নেই কাকার। কাকিমার অবশ্য একজন ভাই আছে। তবে তার সাথে তেমন সম্পর্ক নেই এদের। প্রতি সিজনে যেসব ফল-ফসল হয়, কাকা তাঁর থেকে সামান্য কিছু হলেও সকলের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সকালে খেয়ে বাড়ি দিয়ে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যার আগে আগে ফেরে। সারাদিন জমিতে নানান কাজ করে। কাকার হাতে যেন সোনা ফলে, কখনো কোন অভাব দেয় যায় না ওদের সংসারে। এতো সুখী পরিবারের এলাকায় দুইটি আছে কি-না সন্দেহ!
এমন শান্তির জীবনে এ কোন অন্ধকার নেমে এলো! জসিম কাকা ঘরের কোণে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কোন কথা বলছে না, কাঁদতে না, যেন একদম পাথর হয়ে গেছে। কাকি মা চিৎকার করে কাঁদছে, কিছু সময় পর পর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন মহিলা কাকিমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে। মাথায় তেল পানি দিয়ে দিচ্ছে, হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছে।
পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। হয়তো এখনই চলে আসবে। পুলিশ আসার পরে তিন্নির লা’শ’টা নিয়ে যাবে। ফুলের মতো মেয়েটার শরীর কে’টে নানান পরীক্ষা করবে। না চাইতেও চোখের পানিতে কপল ভিজে যাচ্ছে আমার। এইতো সকালেই তিন্নি আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। আমার কোনো ভাই-বোন নেই, তিন্নিকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসতাম। বাড়িতে থাকলে বেশিরভাগ সময় ওঁর সাথে কাটিয়ে দিতাম। ওঁদের বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে বুড়িটা আমার জন্য বাটিতে করে নিয়ে আসতো। মা’য়ের কাছে দিয়ে বলতো, ” এইটা ভাইয়াকে দিবে, আর তুমি একটু খাবে। বেশি খাবে না যেন। ঠিক আছে?” ওর কান্ড দেখে সবাই খুব হাসতো। মা মাঝে মাঝে বলতেন তিন্নি আমার আপন বোনের মতো, র’ক্তে’র সম্পর্ক ছাড়াই আমরা আপন ভাই-বোন। কত খুনসুটি করেছি তিন্নির সাথে, একে একে সবকিছু মনে পড়ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চাইলেও চিৎকার করতে পারছি না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে শুধু।
পুলিশ এসেছে বেশ কয়েক মিনিট আগে। সবাইকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু কে খু’ন করেছে বা কে খু’ন করতে পারে তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। জসিম কাকার শত্রু নেই, কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ নেই, তাই কারো কথা বলতে পারছে না কেউ। ওসি সাহেব কাকার কাছে গিয়ে বসলো।
” আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? “
” না স্যার। কাকে সন্দেহ করবো আমি! আমার তো কোন শ’ত্রু নেই, মেয়েটা সকালেও একদম সুস্থ ছিলো। মেয়েটাকে সবাই খুব পছন্দ করতো। ওঁকে খেলতে দেখে আমি কাজে গিয়েছি, দুপুরের পর পর তিন্নির মা’য়ের কথা শুনে বাড়িতে এসে দেখি আমার মেয়ে..”
জসিম কাকা আর কিছু বলতে পারলেন না। কন্ঠ জড়িয়ে গেল তাঁর । একটাই মেয়ে উনার, তাকে হারিয়ে আজ একদম নিঃস্ব হয়ে গেছেন। যেহেতু কাকা কাউকে সন্দেহ করে না বা কারো নামে মা’ম’লা করেনি, তাই পুলিশ নিজের মতো করে হ’ত্যার তদন্ত করবে। পুলিশের লোকজন তিন্নির লা’শটা নিয়ে চলে গেলো। পো’স্ট’ম’র্টে’ম করার পর লা’শ দা’ফ’ন করতে পারবে।
তিন্নিদের বাড়িতে গ্রামের সব লোক জড় হয়েছে। এতো লোকজনের ভিতরও একদম একা লাগছে নিজেকে। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। ওদের বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ে তিন্নির লা’শ পাওয়া গেছে। দুপুরের পর পর কাকি মা ওদিকে পাতা কুড়াতে গেছিল। তখনই তিন্নির এই অবস্থা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে৷ উনার চিৎকারে লোকজন জড় হয়।
বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে চলে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করছি। কান্নার কারণে মাথা যন্ত্রণা করছে খুব। এক হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে আছি, এতে কিছুটা ভালো লাগছে। ছোট বেলা থেকে অনেক গোয়েন্দা কাহিনী পড়েছি। ইচ্ছে করছে নিজেই তিন্নির খু’নীকে খুঁজে বের করে একই রকম ভাবে মে’রে ফেলি। কথাটা মাথায় আসতেই বাড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যদিও পুলিশ জায়গাটা খুব ভালো করে দেখেছ, কিন্তু তবুও আমি নিজে দেখতে চাই। লোকজনের ভিড়ে যতটা পারলাম একটা সুত্র খোঁজার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না। পুকুরের ওদিকটায় ঝোপঝাড়, ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটু সামনে একটা খোলা মাঠের মতো। তবে বেশি জায়গা না, মাঠের ওপারে বড় রাস্তা দেখা যায়।
হাঁটতে হাঁটতে মাঠে চলে এলাম। মাঠে নামার পথ বেশ ঢালু। এদিকে একটা বড় মেহগনি গাছ। বেশ পুরনো। গাছের গোঁড়ায় শেষ বিকালের রোদ এসে পড়েছে, ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম কয়েকটা ভাঙা কাঁচের চুড়ি সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে এগিয়ে গেলাম। চুড়িগুলো হয়তো আমি চিনি, দুপুরে ঘুমানোর আগে ফুফুর হাতে ঠিক এই রঙের চুড়ি দেখেছিলাম। কিন্তু এখানে ফুফুর চুড়ি আসবে কি করে? তাহলে কি ফুফু তিন্নিকে মে’রে ফেলেছে। সারা শরীর দরদর করে ঘামছে। এক অজানা শিহরণ বয়ে চলেছে শিরায় শিরায়!
দাদির মুখে শুনেছি ফুফু ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি আর বদরাগী ছিলেন। একবার দাদা ফুফুকে একটা চড় মেরে ছিলো, ফুফু ঘরে দরজা আটকে বসে ছিলেন। দু’দিন পর্যন্ত কিছু খায়নি, সারাদিন ঘরে দরজা আটকে বসে ছিল। এমনকি ছয় মাসের মতো দাদার সাথে কথাও বলতো না। তখন ফুফুর বয়স ছিলো মাত্র দশ বছর। তাহলে এখন কেমন একরোখা হয়েছে কল্পনা করা যায়। সকালে তিন্নির কথার জন্যই বাবা ফুফুকে চড় মেরেছে। পরক্ষণেই মনে হলো, এভাবে না জেনে কাউকে দোষ উচিত না।
চুড়ির টুকরোগুলো পকেটে রেখে দিলাম। আমি কোন সূত্র বের করতে না পারলেও পুলিশ ঠিক পারবে। বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে! যেন তিন্নি হারনোর শোকের ছায়া চেপে ধরেছে আমার পরিবারে।
সন্ধ্যায় সকলে মিলে ইফতার করতে বসেছি। ফুফু একদম চুপচাপ, কোন কথা বলছে না।
” আচ্ছা ফুফু ঈদের জামা মানুষ ঈদের দিন পরে, আপনি সকালে শাড়িটা কিনতে না কিনতে বিকেলে তিন্নিদের বাড়িতে সেই শাড়ি পরে গেলেন? “
ফুফু তিন্নির কথা শুনে মিহিয়ে গেলো। চাপা গলায় বললো, ” এমনিতেই পরে ছিলাম, ঠিক আছে কিনা দেখতে, পরে ভাবলাম যাই গিয়ে তিন্নির মা’কে দেখিয়ে আসি। তুমি হঠাৎ আমার কাছে এসব জানতে চাইছো কেন?”
” কিছু না এমনিই। হঠাৎ মনে পড়লো। “
“ওহ,”
সবাই আবারও নিরবে খেতে লাগলেন। খাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে চলে গেলো। আমি নামাজ শেষ করে ফুফুর কাছে গেলাম। ফুফু তখন মোবাইলে কিসব করছে।
” আপনার সাথে একটু কথা ছিলো ফুফু। “
” তোর সাথে আমার কোন কথা নেই, যদি কিছু বলার থাকে তাহলে মা ভাইকে বলবো, তোকে নয়। “
” তিন্নির যেখানে খু’ন হয়েছে সেখানে আপনার এই চুড়িগুলো পাওয়া গেছে “
পকেট থেকে চুড়ি কয়েকটা বের হরে ফুফু হাতে দিলাম। ফুফু সেগুলো হাতে নিয়ে কাঁপতে লাগলো।
” বাদশা এতে রক্ত লাগানো কেন? জানিস না আমি রক্ত কতটা ভয় পাই! “
ফুফু চুড়িগুলো মেঝেতে ফলে দিলেন। সত্যিই ফুফি রক্ত দেখতে পারে না। বাড়িতে হাঁস মুরগী জ’বা’ই করলে ফুফু তাঁর ধারে কাছেও আসে না। তবে এক টুকরো চুড়িতে সামান্য একটু রক্ত দেখে এতোটা ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক লাগলো আমার কাছ। মেঝে থেকে চুড়িগুলো তুলে নিলাম। স্বযত্নে পকেটে রেখে ফুফুর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কাজ বেড়েছে আমার। যেভাবেই হোক খু’নিকে খুঁজে বের করতে হবে আমার। সেই সাথে মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে হবে। না হলে ঈদে মা’য়ের কিছুই পাওয়া হবে না, সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমি বের হতেই ফুফু দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর বন্ধ ঘরে কি করছে জানার উপায় নেই আমার। ফুফুর হাবভাবে মনে হচ্ছে ফুপু কিছু হলেও জানে। কিন্তু বলতে চাইছে না।
মা’য়ের নম্বর নিয়ে সকালের ব্যবসায়ী কাকুকে কল দিলাম। দুবার রিং হওয়া পর রিসিভ করলেন।
” কে বলছেন?”
“আমি বাদশা, আপনি নম্বর চেয়েছিলেন তাই কল দিলাম।”
“ওহ, সকালের সে-ই ছেলেটা। “
” জ্বি। তা তোমাকে তো দুইটা কাজ দিলাম, তোমার পারফরম্যান্স খুব ভালো লেগেছে আমার। উনারা দুইজন বললেন খুব তাড়াতাড়ি খাবার পেয়ে গেছে। “
” জ্বি ওনাদের বাসার ঠিকানা চেনা ছিলো। “
” তা বেশ, তাহলে কাল চলে এসো। কাল দেখা যাবে কয়টা খাবার ডেলিভারি থাকে৷ যত বেশি অর্ডার ততো বেশি লাভ। তোমারও আর আমারও। “
“জ্বি আচ্ছা। তাহলে এখন রাখছি। “
” তা বেশ।”
প্রচন্ড ঘুম আসছে আমার। মোবাইল মা’য়ের ঘরে রেখে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সবে আটটা বাজে। এতো সকালে কখনো ঘুমাতে যাই না আমি।
কারো কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। ঘড়িতে তখন দুইটা বাজে, ঘন্টা খানেক পরে আবার সেহরির জন্য উঠতে হবে সবার। কান্নার শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। ফুফুর ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে। কিন্তু এতো রাতে ফুফু কাঁদতে যাবে কেন!
চলবে