কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪
চারপাশের পরিবেশ অদ্ভুত ধোঁয়াশায় ভরে গেছে। দরজার কড়া নাড়লাম। কোন সমস্যাও হতে পারে, না জেনে কোন কিছু মনে করা উচিত হবে না। কড়া নাড়ার শব্দে কান্না থেমে গেল। কিন্তু কথা বললো না, আমিও আর দাঁড়িয়ে রইলাম না। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে, রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। ইফতারের সময়ও বেশি কিছু খাওয়া হয়নি। রান্নাঘরে গিয়ে নিজের মতো করে খাবার খেয়ে আবারও ঘুমাতে চলে গেলাম৷ সকালে পড়া আছে, তারপর আবার খাবার ডেলিভারি দিতে হবে। তাছাড়া তিন্নির ব্যাপারটাও আমি দেখবো। হয়তো আমার বয়স কম, তবে ইচ্ছে শক্তি আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকলে সবকিছু সম্ভব। আমার বন্ধু মানিকের বাবা একজন পুলিশ অফিসার। আমাদের থানায় উনার পোস্টিং। দরকার হলে মানিকের সাথে কথা বলে উনার কাছে সাহায্য চাইবো। তবে যে আমার ছোট্ট বোনটাকে এমনভাবে হ**ত্যা করতে পারে তাঁর কোন নিস্তার নেই।
সেহেরি সময় হয়ে গেছে। মা দরজায় কড়া নাড়ছে।
” বাদশা, খেতে উঠবে না? সময় হলে গেলো তো। এই ছেলেটাকে রোজ এভাবে ডাকতে হয়। “
” আমি একটু আগে খেয়েছি মা, তোমরা খেয়ে নেও। “
” তুই না খাস, জসিম কাকদের বাড়িতে খাবার দিয়ে আয়। এই অবস্থায় কি রান্না করছে না করছে আল্লাহ জানে। “
অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো। মা একটা ব্যাগে টিফিন বক্স সাজিয়ে দিয়েছে। সেগুলো নিয়ে তিন্নিদের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। চারিপাশ একদম নিস্তব্ধ, ওঁদের বাড়ির কাছে আসতেই কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এখনও বেশ কয়েকজন লোক রয়েছে, হয়তো ওঁদের অবস্থা বুঝে ওঁদের সাথে আছে। জসিম কাকা এখনও সেইভাবে বারান্দায় বসে আছে। কাছে গিয়ে সালাম দিলাম।
” আসসালামু আলাইকুম। “
” ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা, কিছু বলবে?”
” আপনাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। সেহেরিতে কিছু খেতে হবে তো নাকি!”
” জানো বাবা আমার সোনা মা প্রতিদিন রোজা রাখার বায়না করতো। সেহরির সময় সবার আগে ঘুম দিয়ে ওঠে যেতো, একটা রোজাও রাখতে পারলো না আমার পাখিটা। উড়াল দিয়ে চলে গেল। “
বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কাকাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা জানা নেই আমার। প্রথম রোজার দিন তিন্নি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
” রোজা আছো বাদশা ভাই?”
হেসে বলেছিলাম, “হুম আছি। তুই রোজা আছিস?”
” হয় এখনও আছি, তবে ছেলে বলেছে একদিনে তিনটে রোজা থাকতে। তাহলে আমার নব্বইটা রোজা হবে। তুমি একদিন একটাই রোজা রাখো তাই তো তোমার মোটে তিরিশটা। হি হি হি। “
মেয়েটা ছোট্ট ছোট্ট আঙুল গুনছিল আর এসব বলেছিল। তিন্নি জসিম কাকাকে ছেলে ডাকে। ছোট বেলায় জসিম কাকার মা মা**রা গেছে, তাই মেয়ের মাঝেই মা’কে খুঁজে পেতেন তিনি।
” কাকা কিছু একটু খেয়ে নিন। “
” গলা দিয়ে খাবার নামবে না রে বাজান। তুমি দেখ, যদি তোমার কাকিকে কিছু খাওয়াতে পারো! “
খাবারের ব্যাগ হাতে ঘরের ভিতর গেলাম। কাকি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। হয়তো অতিরিক্ত কান্নার জন্য এমনটা হয়েছে। দুইজন মহিলা কাকির মাথার পাশে বসে আছে। কাকিকে কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু উঠলো না। বসে থাকা মহিলাদের ভিতর একজনের হাতে ব্যাগ দিয়ে বললাম, ” আপনারা খেয়ে নিন, কাকির জ্ঞান ফিরলে যদি পারেন কিছু খাইয়ে দিবেন। “
ঘর থেকে বেরিয়ে কাকার পাশে গিয়ে বসলাম। দেখে মনে হচ্ছে উনার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সাহস করে কাঁধে হাত রাখলাম। কাকা বাচ্চাদের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
” বাবা রে কে আমার এমন স”র্ব”না”শ করলো? আমি তো কারো ক্ষতি করি না, কারো সাথে আমার বিবাদ নেই। আল্লাহ আমার কলিজাকে রেখে আমাকে কেন নিয়ে গেলেন না! “
” যে-ই এমন করুক সে ছাড়া পাবে না, আমি আপনাকে কথা দিলাম। বোনের খু”নিকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবো। “
” তাইলে কি আমার মা ফেরত আসবে রে বাবা!”
” তা আসবে না, তবে যে এতটুকু বাচ্চার সাথে এমন করেছে তার বেঁ*চে থাকার কোন অধিকার নেই। “
কাকার চুপ করে রইলেন, বাড়িতে ফিরে আসলাম। ফুফু মা সবাই টেবিলে বসে খাচ্ছে। ফুফুকে ভালো মতো লক্ষ্য করে দেখলাম, উনার চোখ মুখ ফোলা ফোলা। মলিন মুখে বসে খারাপ খাচ্ছে।
ঘড়িতে এখন সকাল ছয়টা, সাইকেল নিয়ে স্যার বাড়ির দিকে যাচ্ছি। কিন্তু আজ শরীরের বল পাচ্ছি না। পড়া শেষ মানিকের সাথে কথা বলার ইচ্ছে ছিল, মানিকের বাবার সাথে দেখা করবো বা উনার নম্বরটা নিবো। কিন্তু মানিক আজ আসেনি। বাড়িতে গিয়ে মানিককে কল দিতে হবে। পড়া শেষে ব্যবসায়ী কাকার কাছে গেলাম। আমি দেখে উনি হাসতে শুরু করলেন,
” তুমি তো ফা**টি**য়ে দিয়েছ।”
” আপনার কথায় অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু খোলাসা করে বলেন। “
” আগের দিনের কাস্টোমার দু’জন আবার অর্ডার দিয়েছে আজ। তোমার ব্যবহারে তারা বেশ খুশি। “
” আচ্ছা তাহলে আজ কোথায় কোথায় যেতে হবে। “
” আজ সকালে কোথাও যেতে হবে না, তুমি দুপুরের পর পর চলে এসো। ”
” রোজা রেখে দুপুরের পর! আচ্ছা সময়মতো চলে আসবো। “
উনি পকেটে থেকে বিশ টাকার তিনটা নোট বের করে আমার হাতে দিলেন। তারপর হনহন করে নিজের কাজে চলে গেলেন। জীবনের প্রথম রোজগারের কি অদ্ভুত অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না। বাড়ি ফেরার পথে একটা মাটির ব্যাংক কিনলাম। তিরিশ টাকা নিয়েছে, বাকি তিরিশ টাকা ব্যাংকের ভিতর ফেলে দিলাম। টেবিলের নিচে যত্নসহকারে ব্যাংকটা রেখে দিলাম। তিন্নির লা**শ বিকালের দিকে বাড়িতে নিয়ে আসবে। এমন সুন্দর একটা ফুলকে কেউ খুব বাজে ভাবে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে, এখন আবার কুচি কুঁচি করে দিয়েছে।
দুপুরের পর মা আর দাদি তিন্নিদের বাড়িডে গেলেন। বাড়িতে ফুফি একা। সুযোগ বুঝে ফুফুর ঘরের দিকে চলে গেলাম। ফুফু তখন খাটে বসে চুলে দিচ্ছে।
” তোমার সাথে একটু কথা ছিল ফুফু। “
” কি কথা বলতে এসেছিস? যা বলার তাড়াতাড়ি বল। “
” তিন্নিকে কে মে*রে**ছে? “
” আমি জানি না। “
” তুমি সবকিছু না জানলেও কিছুটা জানো। দয়া করে এভাবে লুকিয়ে রেখো না। তুমি কি চাও না ওর খু”নি শা*স্তি পাক? “
ফুফু চুপচাপ বসে আছে, ফ্যান চলছে তবুও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। উত্তর না পেয়ে আবারও বলে উঠলাম, ” ফুফু তুমি যদি খু””*ন করে থাকো, তাহলে আজ বা কাল ঠিকই শাস্তি পাবে। তাছাড়া পুলিশ নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টা দেখছে। “
“বিশ্বাস কর বাদশা, আমি কাউকে খু**ন করিনি৷ এতো ক্ষমতা আমার হবে না। তুই এখন আসতে পারিস। “
” মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকিয়ে যাচ্ছো আমার থেকে। “
” সারাক্ষণ গোয়েন্দা গল্প পড়ে তোর স্বভাবও ওদের মতো হয়ে গেছে, অহেতুক প্রশ্ন করছিস। “
” তাহলে তোমার চুড়ি ওখানে কি করে গেল?”
” এটা আমার চুড়ি না। “
” ফুফু তুমি হয়তো ভুলে গেছ, আমার স্কুলের সামনে থেকে এই চুড়িগুলো কিনেছিলে, আমিও তখন তোমার সাথে ছিলাম। “
” এক রঙের কি আর চুড়ি নেই নাকি?”
” তা নিশ্চয়ই আছে, তবে তোমার কাছে যে চুড়িগুলো আছে, সেগুলো গুনে দেখলে কয়েকটা কম পড়বে। “
” তুই কি যাবি এখান থেকে?”
“হ্যাঁ, আমি চলে যাচ্ছি। আজ বিকালে পুলিশরা আসলে ওদের চুড়িগুলো দিয়ে দিবো। “
ফুফুর সাথে আর কথা বাড়ালাম না। হয়তো এখন খাবার ডেলিভারি দিতে যেতে হবে। মা’য়ের মোবাইল দিয়ে ব্যবসায়ী কাকাকে কল দিলাম।
” আসসালামু আলাইকুম কাকা। আজ কি ডেলিভারি দিতে হবে না? “
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, না বাবা আজ ডেলিভারি দিতে হবে না। “
” আপনি না বললেন অনেকগুলো অর্ডার পেয়েছেন। “
” হ্যাঁ তা পেয়েছি, তবে কাল সকালের। আজকে যে অর্ডারটা ছিল তা বাতিল হয়ে গেছে। “
” আচ্ছা ঠিক আছে। “
এই খাবার ডেলিভারির কাজ করে মা’য়ের জন্য শাড়ি কেনা প্রায় অসম্ভব দেখছি। এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে কাজ করলে তো ঈদ চলে আসবে কিন্তু টাকার ব্যবস্থা হবে না। টাকা রোজগার করা যতটা সহজ মনে করেছিলাম ততোটাও সহজ নয়। বিকালের দিকে তিন্নির লা**শ নিয়ে আসলো। ইফতারি পর জানাজা তারপর ক*ব*র দেওয়া হবে।
তিন্নির ক**ব**রে মাটি দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে নানান স্মৃতি ভেসে ওঠছে। সত্যিই প্রিয়জনকে ক*ব*র দেওয়া সহজ বিষয় নয়। কোন রকম মাটি দিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। শরীর খারাপ লাগছে, এমন লা**শ আগে পরে কখনো ক*ব*র দিতে যায়নি, তবে তিন্নিকে খুব কাজ থেকে দেখেছি। হয়তো মনের মাঝে ভয় ঢুকে গেছে।
মা, বাবা, দাদি সবাই ওঁদের বাড়িতে, এখনও ফেরেনি। শুধু ফুফু বাড়িতে, আমিও এই মাত্র ঘরে ঢুকলাম। মিনিট পাঁচেক বসার পর ফুফু আমার ঘরে এলেন।
” বাদশা তোর সাথে কিছু কথা আছে আমার। “
” আমার সাথে আবার কি কথা?”
” তিন্নির ব্যাপারে!”
” বলেছিলাম না তুমি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানো। আমার অনুমান ঠিক হলো তাহলে। তুমি কিছু না কিছু জানো। “
ফুফুর মুখটা মলিন হয়ে গেলো। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন,
” সেদিন সকালের ওই ঘটনায় ভীষণ রাগ হয়েছিল তিন্নির উপর। বাচ্চা মেয়ে এতো বেশি বুঝবে কেন! কিন্তু পরবর্তীতে ভেবে দেখলাম ওর তো কোন দোষ নেই, ও তো সত্যি কথাই বলেছে। তাছাড়া আমি তো ও-কে এ ব্যাপারে কিছু বলতে নিষেধও করিনি। কিন্তু তবুও নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না।
চলবে