#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
দুপুরবেলা বিভোর এলো না। নাসিমা ফোন করে আসতে বললেন। কিন্তু ও সাফ জানিয়ে দিলো বাবার অপমান ওর গায়ে লেগেছে। এভাবে একটা মেয়ের সামনে বাবা কেন ওরকম হাস্যরসাত্মক কথা বললো! একজন ডাক্তার ও, নূন্যতম সম্মান দিয়েও ছেলের সাথে কথা বলে না। সারাক্ষণ বিয়ে কর, বিয়ে কর বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। অনেক জোড়াজুড়ি স্বত্তেও বিভোর নাদিরার বাসায় ফিরতে রাজি হলো না। এদিকে ছেলে না খেয়ে আছে সেটাও হজম করতে পারছেনা নাসিমা চৌধুরী। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে গেলেন।
নাদিরা গোমড়ামুখে বললেন,
‘ ছেলেটা কি সারাদিন না খেয়ে থাকবে? সকালে তো কিছুই খায়নি।’
‘ সেটা এই বুড়োকে কে বোঝাবে? সারাদিন ছেলেটার পিছু লেগে থাকে।’
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন নাসিমা। বাবর চৌধুরী আরাম করে টিভি দেখছেন। গালে হাত দিয়ে এমন ভঙ্গিতে বসেছেন যেন এই নিউজটা না দেখলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই বৃথা। নাসিমা চৌধুরী হাত থেকে রিমোট নিয়ে টিভি বন্ধ করে বললেন,
‘ খাবার দিচ্ছি, দিয়ে আসো বিভোরকে।’
‘ আমি?’
‘ তাহলে আর কে?’
‘ নো নেভার।’
‘ তাহলে কি ছেলে না খেয়ে থাকবে?’
‘ থাকুক। একবেলা না খেলে কিছু হবেনা।’
‘ তুমি কিন্তু বেশি কথা বলছো!’
‘ দেখো গিয়ে হসপিটালেই লাঞ্চ খেয়ে নিয়েছে।’
‘ আমার ছেলে বাইরের খাবার খায় না।’
‘ তাই নাকি? জানতাম না তো।’
‘ এখন তো জানলে, সো যাও।’
‘ দেখো আমার হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে। কোথাও যেতে পারবো না।’
‘ সব না যাওয়ার মতলব।’
‘ তাহলে তুমি যাও, মা হিসেবে এটা তোমার দায়িত্ব।’
‘ বাবাদের বুঝি কোনো দায়িত্ব নেই?’
‘ আছে। ছেলেকে চারবেলা থাপড়ানো।’
‘ তুমি কি পাগল? মাথা কি পুরাই গেছে?’
‘ আমার মাথা ঠিক আছে।’
‘ তাহলে উল্টাপাল্টা কথা বলছো কেন?’
‘ তোমার ছেলেকে আগে বলো বিয়ে করবে কিনা? নয়তো এরকমই করবো!’
‘ তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তুমি নিজেই বিয়ে করতে চাচ্ছো?’
হুংকার দিয়ে বললেন নাসিমা। বাবর চৌধুরী ব্যক্কল বনে গেলো। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার আগেই চুপচাপ ঘরের দিকে পা বাড়ালো। নাদিরা অসহায় মুখ করে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। নাসিমা রাগে গজগজ করতে করতে খাবার প্যাক করছেন, নিজেই নিয়ে যাবেন।
রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর। কাঠফাটা রোদে চারপাশ থমকে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। দুপুরের খাবারের সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। হসপিটালে দুটি ওটি শেষ করে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ নিয়ে চেম্বারে গিয়ে বসলো বিভোর। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে গ্লাসের পানিটা ঢকঢক করে খেলো। করিডোর থেকে ভেসে আসছে ফিনাইলের গন্ধ। গা গুলিয়ে বমি এসে গেলো বিভোরের। বমি করার পর একটু শান্তি লাগছে। এসির টেম্পারেচার কমিয়ে হাতের কাজগুলো শেষ করলো। ক্ষিধেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। বাইরের খাবার খাওয়া বাদ দিয়েছে অনেক আগেই, আর সকালের কথা মনে হতেই বাসায় যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেলো। নিজের ছেলেকে এভাবে অপমান, মানতে পারছেনা বিভোর। তাও কেউ সামনে না থাকলে কথা ছিলো, ওই রুহির সামনে যেভাবে বললো বিভোরের নাক কাটা গিয়েছে। বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসা ডাক্তারকে তার বাবা গরুর সাথে তুলনা করেছে এর চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে।
মোবাইল অন করে দেখলো ইভার ম্যাসেজ। ওর বিয়ের কিছু ছবি পাঠিয়েছে। বিভোর ছবিগুলো দেখতে লাগলো, একটা ছবিতে খুঁজে পেলো রুহিকে। মেয়েটা বেশ মায়াবী, ভালো। কিন্তু কি যে হয়েছে ওর, বুঝতে পারছেনা বিভোর। মনে হচ্ছে কোনো কারণে ওর উপর রেগে আছে। কিন্তু ওর সাথে এমন কিছুই তো ঘটেনি। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে ভাবনায় ডুব দিলো বিভোর। কিছু হিসেব মিলছে না। এই প্রথম কোনো মেয়ের মন বোঝার চেষ্টা করছে, জান্নাহের বেলায় এটি করেনি বিভোর। কি জানে, কেন করেনি! সেদিন যখন রুহির সাথে কথা বললো তখন বেশ খুশি হয়েই বিভোরের সাথে কথা বলছিলো রুহি। ওর চোখে বিভোর মুগ্ধতা দেখতে পেয়েছে। অনেকদিন পরে প্রিয়জনের সাথে দেখা হলে মানুষের এক্সপ্রেশন যেমন হয়, তেমনই এক্সপ্রেশন ছিলো রুহির। কিন্তু বিভোর যখন বললো যে ডিভোর্স করে দিবে তাতেই মেয়েটার রুপ পাল্টে গেলো। কেন?
প্রেম, ভালোবাসায়ই নাকি অভিমান, অধিকারবোধ থাকে? তাহলে কি রুহি ওর সাথে অভিমান করেছে? রুহি কি চায় না, ওদের ডিভোর্স হোক? আবার, রুহি যখন অন্য কারো সঙ্গে কথা বলে, হাসে তখন ওর প্রতি রাগ হয় বিভোরের৷ অদৃশ্য এক অধিকারবোধ পেয়ে বসে ওকে। মনে হয় এই মেয়ের সাথে কথা বলা, ওর হাসি দেখার অধিকার একমাত্র বিভোরের। তাছাড়া বিভোর কখনো রুহির মতামত জানতে চায়নি, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ভালোবাসা? সেটা কি জিনিস? বিভোর কখনোই জানেনি। কিন্তু রুহি যখন ওকে এড়িয়ে যেতে চায় বিভোরের ইচ্ছে হয় কষিয়ে চড় মারতে। নিজের কাছে বসিয়ে রেখে রুহির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। রুহির অভিমান আর বিভোরের অধিকারবোধ, দুটোই সত্য। তবে কি ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে?
হতভম্ব হয়ে গেলো বিভোর। এইরকম অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় সে। এর সাথে পরিচয় খুব সময়ের। স্ক্রিনে ফুটে আছে রুহির হাসিমাখা মুখ। সবুজ জামদানিতে প্রকৃতি প্রকৃতি লাগছে। রুহি মেয়েটা খুব শান্ত, আর বিভোর কথা বলতে পছন্দ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, বিপরীত ধর্মী চার্জ একে অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এই মুহূর্তে বিভোরও রুহির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে। ক্ষতি কি মেয়েটাকে ডিভোর্স না দিলে? কিছুই না। রুহির সাথে অনায়সে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে বিভোর। বাবর চৌধুরীও ছেলেকে বিয়ে করাতে চাইছে, এই খবর জানলে বোধহয় আনন্দে লাফিয়ে উঠবে। তার ছেলে বিবাহিত। শীতল কণ্ঠে বিভোর স্বগোতক্তি করলো,
‘ তোমাকে আমার চাই রক্তজবা!’
নাসিমা চৌধুরী খাবার রেডি করে গুম হয়ে বসে আছেন। ভেবেছিলো ছেলের জন্য খাবার নিয়ে যাবে, কিন্তু তার এখন মাথাব্যথা করছে। প্রচন্ড ব্যথায় চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আছে। রুহি ঔষধ দিয়েছে। এখন একটু কমলেও কেউ ওনাকে বাইরে বেরুতে দেবেন না। এদিকে বাবর চৌধুরী ভাতঘুম দিয়েছে।
‘ রুহি মা!’
‘ জ্বি আন্টি?’
‘ আমাকে যেতে দাও, সমস্যা হবেনা।’
‘ আন্টি আপনি ঘুমান তো।’
‘ ছেলেটা না খেয়ে আছে।’
এই নিয়ে পঞ্চাশের বেশিবার এই কথাটা রুহিকে বলেছে নাসিমা। রুহি নাছোড়বান্দা, কিছুতেই যেতে দিবেনা। এবার আর না পেরে বলল,
‘ আমি দিয়ে আসবো?’
নাসিমা উৎসাহি স্বরে বলল,
‘ যাবে তুমি?’
‘ দিন, আমিই দিয়ে আসছি।’
‘ দাঁড়াও, ড্রাইভারকে বলে দিই।’
‘ লাগবে না, আমি রিকশা করে চলে যাবো।’
‘ না না। এই গরমে রিকশা করে যাবে কি, বাড়ির গাড়ি থাকতে।’
নাসিমা অনেক জোড়াজুড়ি করে রুহিকে রাজি করালেন। প্যাক করা খাবারগুলো ব্যাগে নিয়ে বিভোরের হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো রুহি। ও কখনো যায়নি, ড্রাইভার হসপিটালে পৌঁছে দেবে। লোকটার সামনে আবার পড়তে হবে ভেবেই অস্বস্তি এসে ভর করলো মনে। কিছুতেই এড়িয়ে চলা যাচ্ছেনা। আধঘন্টা পর হসপিটালে পৌঁছালো রুহি। রিসেপশনিস্টের সাথে কথা বলে জেনে নিলো বিভোরের রুম। তিনতলায় এসে দক্ষিণের করিডোর পেরোতেই দরজার পাশে নেইম-প্লেট দেখতে পেলো রুহি। চকচক করছে মোহাম্মদ বিভোর চৌধুরীর নাম।
ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!