#অবন্তিকা_তৃপ্তি
তখন হোস্টেলে যাচ্ছে অদিতি। ও কাঁধের ব্যাগ একহাতে চেপে অপরহাতে ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। ধ্রুব দৌড়ের সময় ওকে লক্ষ্য করেনি, অদিতি ফোনে কথা বলছিল দেখে ও ধ্রুবকে খেয়াল করেনই। তারপর; তারপর দুজনেই খেলো ধাক্কা একটা। অদিতির ফোন ছিটকে পরলো রাস্তায়। ও চোখ বড়বড় করে, টাল হারিয়ে পরে যেতে নিচ্ছিল। তবে সামলে নিল ধ্রুব।কৌশলে একহাতে চেপে ধরলো ওর পিঠ, অপরহাতে পাশে থাকা গাছ ধরে নিজেকেও একইসঙ্গে পরে যাওয়া থেকে আটকে ফেলল। অদিতি তখন হাতের আঙুল দিয়ে খামচে ধরেছে ধ্রুবর বুকের কাছের টিশার্ট।
ধ্রুব অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে অদিতিকে, অদিতির আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া মুখটি। ওর নাক, ওর তিরতির করে কেপে উঠা ঠোঁট, কুঁচকানো দুই চোখ! সবকিছুই, সবকিছু মারাত্মক ভাবে গ্রাস করে নিল শক্ত-পাথর মজার ধ্রুব ইয়ামিনকে। ধ্রুব অনুভব করলো, ওর বুক কাঁপছে, ওর শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। ও স্বাভাবিক নয় ভেতরে ভেতরে, সবটাই ধ্রুবর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।ধ্রুব; ধ্রুব ইয়ামিন সম্ভবত ফেঁসে গেছে। অদিতি আশেপাশে ভয়েভয়ে তাকাল, কেউ কি দেখে নিয়েছে? না, কেউই দেখেনি। ও স্বস্থির শ্বাস ফেলল, তারপর চোখ-মুখ খিঁচে ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিলো, ধ্রুব বুঝতে পেরে সাথেসাথেই ছেড়ে দিল অদিতিকে। দুজনেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আর ধ্রুবর দিকে একবারও তাকাল না। ও রাস্তায় আশেপাশে খুঁজতে লাগলো কিছু। রাস্তার একপাশে ভেঙেচুড়ে পরে থাকা ফোনটা দেখতে পেলো।ভাঙা ফোন হাতে তুলে অদিতির মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ও একবার ধ্রুবর দিকে চেয়ে পরপর চোখ গড়িয়ে নিয়ে ফোন হাতে উঠে দাঁড়াল। ধ্রুব অদিতির মন বুঝে আগ বাড়িয়ে বললো-
‘ভেঙ্গে গেছে না? আমি এটার ক্ষতিপূরণ-‘
‘না।’ -অদিতির সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিয়ে দিলি। ও চায়না; ধ্রুবর সঙ্গে এভাবে বারবার, বারবার কোনো না কোনোভাবে ওর দেখা হোক। অদিতি কখনোই চাইবে না; যার জন্যে অদিতির মন বার্ভার বেইমানি করে কিছু একটা অনুভব করে, তার চোখে-চোখ মেলাতে। অদিতি ঠিক করেছে, ও আজ থেকে এড়িয়ে যাবে ধ্রুবকে। যতটা পারা যায়, চোখে চোখ মেলাবে না। চোখে চোখ মেলালেই ওর বিপদ,ঘোর বিপদ!
অদিতি তারপর ধ্রুবর দিকে আর একবারও তাকাল না, দ্রুত ওকে এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল। ধ্রুব আহাম্মক হয়ে অদিতির কাজগুলো দেখে গেল। মেয়েটার হুট করে হয়েছেটা কি ও বুঝতে পারল না।অদিতি চলে যেতেই রাজু এবার দূর থেকে এগিয়ে এলো ধ্রুবর দিকে। দুজনেই একীশঙ্গে অদিতির যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে, রাজু নিজে এবার কিছুটা অবাক হয়ে বললো-‘ ধ্রুব ভাই; ভাবি কি পালিয়ে গেল তোমার থেকে?’
ধ্রুব ভ্রু কুচকালো, সেভাবেই অদিতির যাওয়ার দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে বললো-‘এটা পালানো ছিলো?’
রাজু সায় দিয়ে বললো-‘পালানোই তো। আমার সিক্স সেন্স বলছে, ভাবি আজকের পর তোমার মুখোমুখি আর হবে না।’
ধ্রুব নিজের মধ্যে হয়তো নেই, ও বোকার মতো প্রশ্ন করে বসে-‘ কেন? ও আমার মুখোমুখি কেন হবে না?’
রাজু একের পর এক ধ্রুবর অবিশ্বাস্য প্রশ্ন শুনে নিজেই হতবম্ব হয়ে গেল। ও এবার ধ্রুবর হাত ঝাঁকিয়ে বলল —‘ভাই, আপনি ঠিকাছেন?’
ধ্রুব সম্বিত ফিরে পেল এবার। ও এস কি সস্তা কথা বলছে? ধ্রুব ইয়ামিনের বৈশিষ্টের সঙ্গে এসব যায়না। তাই ধ্রুব চোখ সরিয়ে রাজুর দিকে চেয়ে আবার মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করে, গলা খাকারি দিয়ে পুনরায় নিজের ফর্মে ফেরার চেষ্টা করল।
__________________
সকাল থেকে খালিপেটে বেরিয়েছিলো অদিতি। দুপুরের দিকে এবার ক্ষুদায় পেট চো-চো করতে শুরু করে দিয়েছে। তাই ক্লাসের ফাঁকে একবার ব্রেক পেয়ে ক্যান্টিনে এসে বসেছে, সিঙারা আর চা অর্ডার দিয়েছে।
হঠাৎ অদিতির সামনে এসে বসে পড়ল ধ্রুবদের ক্লাসের এক ছেলে। অদিতি ভরকে গিয়ে বড়বড় চোখে তাকাল ছেলেটার দিকে। ছেলেটা অদিতির দিকে হেসে তাকাল। পরিচিত হওয়ার জন্যে হ্যান্ডশেকের জন্যে একহাত বাড়িয়ে দিয়ে হালকা হেসে বললো —‘হ্যালো অদিতি, আমি তন্ময়।’
অদিতি তন্ময়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকালো। হ্যান্ডশেক করাও কি এই ঢাকা শহরে ভীষণ স্বাভাবিক? অদিতি অস্বস্তিতে পরে গেল। ও হাত না বাড়িয়ে, নিচু গলায় সরাসরি বললো -‘কিছু বলবেন ভাইয়া?’’
‘ ভাইয়া’ ডাক, তারমধ্র আবার হ্যান্ডশেক না করায় তন্ময় লজ্জা পেয়ে হাত নামিয়ে নিল। গলা খাকারি দিয়ে বলল -‘হ্যা, আসলে আমি তোমার গান শুনেছিলাম। অসম্ভব সুন্দর গান গাও তুমি।’
অদিতি ধীমে স্বরে বলল -‘থ্যাঙ্ক ইউ’
হঠাৎ ওদের কথার মধ্যে ধ্রুব ওর সঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকলো। অনেকে সালাম দিল সিনিয়র হিসেবে ধ্রুবকে দেখে।ধ্রুবর চোখ সহসাই গেল ক্যান্টিনের একপাশে বসে থাকা তন্ময়-অদিতির দিকে। ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেল সঙ্গেসঙ্গেই। ওর কানের কাছে সুমন এসে বিড়বিড় করলো-‘ ভাই, তন্ময় আবার আপনার জিনিসে নজর দিচ্ছে। দেখেন ভাবিকে যেভাবে দেখছে, মনেহয় খেয়ে ফেলবে।’
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে সুমনের দিকে তাকাল। চোখ দিয়ে শাসাতেই সুমন ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ হয়ে গেল। ধ্রুব নিজের মতো করেই গিয়ে একটা চেয়ারে বসল, ওর পাশে বসল থ্রি ইডিয়েটস এর দল।
হঠাৎ অদিতির চোখ গেল ওর সামনে। ও চমকে উঠেছে। ধ্রুব স্বয়ংবর সামনে বসা, অদিতির দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে ক্যানের কোকাকলা গিলছে। যেভাবে অদিতি-তন্ময়কে দেখছে, যেন এক্ষুনি থাবা বসিয়ে দুজকেই দিনে তারা দেখিয়ে দিবে।
অদিতির চেয়ে ছিলো; চোখে-চোখ পরতেই হুট করে ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। অদিতি চমকে উঠে বুকের বা পাশে একহাত রাখল। মনে পরে গেল, ও তো ভেবেছেই ধ্রুবকে এখন থেকে ইগনোর করবে, ধ্রুবর চোখে আর কক্ষনো তাকাবে না। ওই চোখে তাকালেই বিপদ, যখনই অদিতি তাকায় ধ্রুব ইয়ামিন তক্ষুণি যেন নির্লজ্জের মতো চেয়ে থাকে অদিতির দিকে। অদিতির বুক মারাত্মক কাঁপে তখন।
তন্ময় ধ্রুবকে দেখে যেন আরও আশকারা পেল। ও বারবার অদিতিকে এরা-ওটা জিজ্ঞেস করছে। অথচ অদিতি পুরোদমে ইগনোর করতে চাইল তন্ময়কে। সিঙ্গারা এলেই ও এখন থেকে পালিয়ে যাবে। এমনিতেই ওর বুক কাঁপে, তারমধ্যে আবার ধ্রুব এক অদ্ভত ভাবে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। অদিতির ভয়-আতঙ্ক এবার যেন মাত্রা ছাড়াবে।
তন্ময় অদিতির থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বাঁকা চোখে ধ্রুবর দিকে তাকাল, ধ্রুব চোখের ইশারায় তন্ময়কে যেন ভস্ম করে দিতে চাইল। তন্ময় ওর এমন চাওনি দেখে হাসল, পরপর আবার অদিতির দিকে চেয়ে ধ্রুবকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল -‘ক্যান আই গেট ই্যয়ুর নাম্বার? আই গেইজ আমাদের প্রয়োজন পরবে এটার।’
অদিতি চমকে তাকাল তন্ময়ের দিকে। সরাসরি নম্বর চেয়ে বসেছে? অদিতির সিঙ্গারা ততক্ষণে চলে এসেছে। ও সিঙারার প্যাকেটট একহাতে চেপে অপরহাতে ব্যাগ তুলে নিল কাঁধে। তারপর উঠে দাড়িয়ে তন্ময়ের দিকে চেয়ে, তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল-‘আমি আসি।’
বলে দ্রুত একদৌড়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল ও। তন্ময় আহাম্মক হয়ে অদিতির যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। ধ্রুব তীক্ষ্ম চোখে অদিতির যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। ওর হাতের ক্যানের অবস্থা ততক্ষণে মারাত্মক খারাপ। সমস্ত রাগ-জেদ এটার উপরেই ঝাড়ার কারণে ক্যান দুমড়ে মুচড়ে গেছে রীতিমত। ধ্রুব ওটা ফেলে চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে গেল তন্ময়ের দিকে। তন্ময় ধ্রুবকে এগিয়ে আসতে দেখেছে, তবুও ওকে ইগনোর করার চেষ্টা করে আরাম করে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতেকানে হেডফোন লাগাল। ধ্রুব ওর সামনে গিয়ে অদিতির চেয়ারটায় বসলো, তারপর বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-‘হ্যা-লো তন্ময়! আমি ধ্রুব! ধ্রুব ইয়ামিন।’
#চলবে