#ক্যামেলিয়া পর্ব ১৬
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ১৬
সূচনার মৃত্যুতে কোনো শোক নেই।সবার মৃত্যুতে শোক মানায় না।সূচনার মৃত্যুটাও তেমন।তার কষ্টের হিসেব তো সে কারোর কাছে চাইতে পারেনি। নিজের জন্য লড়াই করতে পারেনি অথচ জীবনটা তার নিজের ছিল। তার লাশটা অনাদরে পড়ে আছে গেটের কাছটায়।খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে এসেছে লাশের মা বাবা।দুজনে কাঁদছে অঝোরে। মেয়েকে ডাকছে,
“সূচনা, মারে উঠো। কি হয়েছে আমাকে বলো।মা রে। এত রাগ করে চলে গেলি।একটাবার আমাকে তোর মনের কষ্ট বলতে পারলি না?কি হলো রে মা?”
দূর থেকে দাঁড়িয়ে জাফরিন দেখছিল এসব। ইউভান এসেছে তার হাতের ড্রেসিং করতে। আজ বিকেল বেলা প্লাস্টিক সার্জনের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট রয়েছে। ইদানীং জাফরিনের নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। হুট করেই তার প্রচুর ব্যাক পেইন হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে বা বসেও থাকতে পারে না।মাঝে মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করতে হয় তাকে৷ সে বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে সূচনার লাশের দিকে তাকিয়ে ইউভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমরা সবাই প্রতিবাদী দেখতে পছন্দ করি তবে কেন প্রতিবাদ করতে পারি না?প্রতিবাদ করলেই কেন বেয়াদব তকমা লাগে?”
“একটা গল্প বললে শুনবে?”
“বলো।”
“এক গ্রামে এক কৃষক রয়েছে। সে বেশ ভালো শাক সবজি চাষ করে। এসবের অধিকাংশ গ্রামবাসীদের দিয়ে দিতো। অল্প সংখ্যক সে বাজারে বিক্রি করতো যা দিয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতো সে। একদিন হুট করেই তার উপর দূর্যোগ নেমে এলো।দুধেল দুটো গাই গরু মরে গেল দিন কয়েকের ব্যবধানে। এর ফলে মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে গেল। সারা রাত কান্না করলো পর দিন সকাল বেলা গ্রাম বাসীরা সবজি নিতে এসে হায় হায় করলো, স্বান্তনা দিলো অথচ দিন কয়েক যেতেই পরিবর্তন হতে লাগল তারা।
শুরু থেকেই তারা দেখেছে কৃষক ঠান্ডা মেজাজের মানুষ, তাকে কিছু বললেও সে মেনে নেয় প্রতিবাদ করে না।তাই তাদের যেমন ব্যবহার করতে লাগল তার সাথে।অসুস্থ, বিধ্বস্ত কৃষকের ঘুম দেরীতে ভাঙলো চেঁচামেচির শব্দে।কারণ
একদিন সেই গ্রামবাসীরাই কৃষককে দেরীতে ঘুম থেকে উঠার কারণে বেশ গালিগালাজ করলো। তারা নিজের কাজ ফেলে এখানে এসেছে বিনে পয়সায় দুটো সবজি নিতে। তারা সবজি না নিলে কে নিবে তার এই সবজি?এটা কখনো ভেবে দেখেছে?আর অহংকারী কৃষক কী না তাদের অপমান করছে যারা তার সবজি বিনে পয়সায় নিচ্ছে? এতে কৃষক মুখ ফুটে দুটো জবাব দিতেই তার নামের সাথে যুক্ত হয়ে গেল অহংকারী তকমা।
সেদিন বিকেল বেলা গ্রামবাসীর কথাগুলো কৃষক বেশ মনোযোগ দিয়ে চিন্তাভাবনা করলো।গ্রামের মানুষ যেন দুটো ভালো খেতে পায় এজন্য তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতো সে আর অপর দিকে এরা তাকেই এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অহংকারী তকমা লাগাচ্ছে?
কৃষকের কী হলো সে নিজেই বুঝতে পারলো না।পরদিন ভোর হওয়ার পূর্বেই সে সকল সবজি তুলে নিয়ে চলে গেল শহরের বাজারে। যেখানে চড়া দামেই বিক্রি হয়ে গেল তার সব সবজি। হাতে থাকা টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে ভাবল,
“এত দিন আমি তাদের আপন জন মনে করে নিজের আর্থিক ভাবে কতই না কষ্ট করেছে। কেউ জিজ্ঞেস করেনি তার খারাপ সময়ে যে সে কেমন আছে?অথচ সময় মতোন এসে জিনিস না পেলে তাকে কতই না কথা শোনালো।আমি কেন তাদের কথা চিন্তা করবো?আমি এবার থেকে নিজের কথাটাই আগে ভাববো।এই পৃথিবীতে স্বার্থপরেরাই সুখে থাকে।”
এরপর থেকে সে আর গ্রামবাসীদের কখনো বিনা মূল্যে কিছুই দেয়নি।এরফলে খুব দ্রুতই সবার কাছে সেসব জিনিসের মূল্য দিতে লাগলো।”
“বুঝলাম।কথায় আছে মাগনা দই খেড় পাইতা লই।যখন কোনো কিছুর বিনিময়ে কোনো কিছু দিতে হয় তখন মানুষ বুঝে। আর যারা সব সময় ফ্রি জিনিসে চলতে অভ্যস্ত তারা সেটার কদর করবে না,কারণ সে বুঝেও না অর্থের বিনিময়ে কেনা জিনিস বা অন্যের শ্রম দিয়ে করা কাজের গুরুত্বটা কী হতে পারে। আর যারা বিভিন্ন সময় অর্থের বিনিময়ে কিছু ক্রয় করে তারা যেমন বুঝে নিজের অর্থের জ্বালা তেমনি অন্যের শ্রমের মর্যাদাটাও দিতে জানে।”
“এখানে অর্থ নয়,আমি বুঝিয়েছি সম্মানের কথাটা। একবার খেয়াল কর তো, তুই কী ভেবেছিস কৃষক কে পরবর্তীতে কেউ কিছু বলে নি?অবশ্যই বলেছে। কিন্তু তাদের কথায় পাত্তা না দিয়েও সে নিজের সিদ্ধান্তে স্থির ছিল।কারণ যারা ফ্রিতে সবজি নিতো তারা ভেবেছিল হয়তো কটু কথা বললে সে রাগ করে হলেও দিবে। যেটাতে তাদের লাভ ছিল।
যাক সে কথা,এবার গল্পের মোরাল বলি।
সূচনা আজ লাশ হয়ে পড়ে আছে এতে কারোর দোষের থেকে ওর নিজের দোষ বেশি।হার মেনে নেওয়াটা কী ঠিক হলো।একটু পর পুলিশ আসবে, পোস্ট মর্টেম হবে তারপর জানাজা,দাফন কতো কিছু। ওর কী কষ্ট হচ্ছে না?”
“জানি না, তবে ওর মৃত্যুতে এই পরিবারের সবাই সামিল আছে।”
“শোনো মেয়ে আমি চাই এই লাশ চলে যাওয়ার পর তুমি আজকেই আমার বাপরে বিয়ে করো।তোমার বিয়ে ভাঙ্গছে আর আমার বাপটাও এখন একলা। আজ সন্ধ্যে বেলাই কাজী ডেকে বিয়া পরাই দিতে চাই।”
পিছন দিক থেকে আসা কথা গুলো শুনে জাফরিন বলল,
“আমার বিয়ে আপনার বাপের সাথে মানে?”
“মানে আমার আসিফরে বিয়া করবা। সূচনার জামাই। তোমার বেয়াই।”
“দুনিয়াতে ছেলের অভাব পড়েছে? যে আপনার কাপুরষ ছেলেকে বিয়ে করতে হবে আমার। প্রয়োজনে একজন সৎ রিক্সা চালককে বিয়ে করে সুখী হবো। তবুও আপনার কাপুরষ কে বিয়ে করবো না।”
“মুখ সামলে কথা কও।”
“আমি সূচনা না।আপনি ভাবলেন কী করে আপনার ছেলেকে আমি বিয়ে করবো?যার বৌ আজ আত্মহত্যা করেছে আর যার লাশটাও এখনো বাড়ির উঠোনেই রয়েছে।”
“ওসব ব্যাপার না।ব্যাটা মানুষের একটু দোষ থাকতে পারে।আমিও আমার স্বামীর ২য় স্ত্রী আছিলাম।”
“আপনি ছিলেন বলেই অন্যকে থাকতে হবে এমন নয়। আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।”
“বিয়া না বইলে তোমার বইন এই বাড়িতে থাকতে পারবো?”
“আমার বোন এ বাড়িতে না থাকলেই হবে। তার জন্য আমার বাবা যা রেখে গেছেন তা আপনার লোভের থেকেও অনেক বেশি।”
জাফরিনের শরীর রাগে দুঃখে কাঁপছে। সে তার বড় বোন জামাইকে সবটা জানালে সে ভীষণ রেগে গেল।ততক্ষণে পুলিশ এসে সূচনা কে নিয়ে গেছে।
জাফরিন ব্যাগ গুছিয়ে ইউভানের সাথে বের হবে এমন সময় তার বড় বোন হাত ধরে বলল,
“জাফরিন যাস না।একটু দাঁড়া, আমি কী বলতে চাই একটু বুঝে নিয়ে তারপর না হয় যাস।”
“কি বলতে চাচ্চো আপু?এটাই যে দুই বোন এক সাথে থাকবো, বাবা নেই,তোমার চোখের সামনে থাকলে তুমি শান্তি পাবে। এসব? “
“না আসলে?”
“আপু আপনার শাশুড়ি যা বলছে সে কথাটা আপনি এভাবে মেনে নিলেন?”
“সে আমাকে আমার ছেলের কসম দিয়েছে আর তুই যদি চলে যাস তাহলে আজকের পর থেকে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।”
এবার তার স্বামী রাগ করে বললেন,
“জেমি যে যা বলে তাই শুনে নাঁচতে যাওয়ার অভ্যেস বাদ দাও। যেখানে আমি কিংবা ইয়াকুব পরের ছেলে হয়ে চিন্তা করছি কীভাবে তোমার বোনের জীবনটা সুখের করে তোলা যায় আর তুমি ভাবছো তাকে ডুবাতে?”
“এতে ক্ষতি কী?আপনার ছোটো ভাই…..”
“আপা আমি আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করি কিন্তু আজকের পর আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক রইল না। সূচনা আপুর জায়গায় আপনি আমাকে নরক বাস করাতে চাচ্ছেন যার জন্য মেয়েটা মরেই গেল।কিন্তু দুঃখিত আমি আপনার কথাটাই রাখলাম আজ থেকে আমি আপনার কেউ নই, না আপনি আমার।”
চলবে ….