নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৬৫.
নম্রতার বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগে মারাত্মক এক দূর্ঘটনা ঘটে গেল। হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল নাদিম। ফোন বন্ধ। সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই। ভার্সিটি হলের নির্দিষ্ট ঘরটাও ফাঁকা। অগোছালো জামা কাপড় পড়ে আছে বিছানাজুড়ে। নম্রতা যেন অকূল পাথারে পড়ল। এই ব্যস্ত শহর থেকে হুট করেই এক জলজ্যান্ত মানুষ উধাও! কারো চোখে পড়ল না! কেউ খবর রাখল না? আশ্চর্য! এমন ভয়াবহ দুশ্চিন্তার মাঝেই ফোন করল নীরা। তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছে। সারা শহরে তীব্র ঠান্ডার পর মিষ্টি রোদের ছোঁয়া। নম্রতা ফোন ধরতেই বলল,
‘ জলদি একটু মেডিকেলে আসতে পারবি? প্লিজ?’
নম্রতার সবে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙেই এমন এক আবদারে ভরকে গেল সে। ঘুম ঘুম কন্ঠে তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ কেন? মেডিকেলে কেন? কারো কিছু হয়েছে? এনি ব্যাড নিউজ?’
নীরা ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তুই আয়, বলছি। জলদি আয়। দেরী করিস না।’
নম্রতা ছিটকে উঠে বসল। হাজার ধরনের বাজে চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘন্টাখানেকের মাথায় গিয়ে পৌঁছাল মেডিকেল। নীরা মেডিকেলের করিডোরেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ শুকনো। দৃষ্টি অস্থির। নম্রতা এদিক ওদিক চেয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘ আর কাউকে দেখছি না যে? নাদিমের কোনো খোঁজ পেলি? হঠাৎ হসপিটালেই বা আসতে বললি কেন?’
নীরা তটস্থ চোখে চাইল। নম্রতা অবাক হয়ে খেয়াল করল, নীরা দরদর করে ঘামছে। এই শীতকালেও ঘামের নহর বেয়ে পড়ছে কপাল জুড়ে। নীরা ডানহাতের পিঠ দিয়ে মুখ আর গলার ঘাম মুছে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল,
‘ আমি অ্যাবোরশন করাব নমু। কিভাবে কী করব কিছু বুঝ উঠতে পারছি না। তুই একটু হেল্প করবি?’
নম্রতা প্রথম দফায় কথাটা ঠিক ধরতে পারল না। নীরার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বোকা বোকা কন্ঠে বলল,
‘ অ্যাবোরশন? কীসের অ্যাবোরশন? কার কথা বলছিস?’
নীরা কপালের ঘাম মুছল। শুকিয়ে থাকা ঠোঁটটা জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমি। আমার কথা বলছি।’
নম্রতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। পরমুহূর্তেই উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
‘ অ্যাবোরশন! তারমানে বেবি? ওহ মাই গড! তুই প্রেগন্যান্ট নীরু? আল্লাহ! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে একটা পুচকো আসবে? ওহ গড! ওহ গড! আমার তো পার্টি করতে মন চাইছে…. ‘
পরমুহূর্তেই উচ্ছ্বাসে ভাঁটা এলো নম্রতার। মাঝপথেই থেমে গেল তার কন্ঠস্বর। চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে নীরার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কন্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ অ্যাবোরশন? তুই এইমাত্র অ্যাবোরশনের কথা বললি না? তুই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাইছিস নীরু?’
নীরা অসহায় চোখে তাকাল। নম্রতার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বলল,
‘ এটা খুব প্রয়োজন নমু। খুব খুব প্রয়োজন। তুই একটু হেল্প কর আমায়। আমার কাছে অতো টাকা নেই। এই বিষয়ে কিছু জানিও না। আরফান ভাইকে বলে এতটুকু ম্যানেজ করে দে। প্লিজ নমু।’
নম্রতা কী বলবে বুঝে পেল না। নীরার মতো বুঝদার একটা মেয়ে এমন ফালতু একটা সিদ্ধান্ত নেয় কী করে? নম্রতা রাগ নিয়ে বলল,
‘ পাগল তুই? নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চাইছিস? আমি কাউকে অন্যায় হত্যায় সাহায্য করতে পারি না৷ নীরু! নীরু.. বুঝার চেষ্টা কর, ও তোর বাচ্চা। তোর নিজের বাচ্চা! এই মুহূর্তে বাসায় যাবি তুই। এসব কোন ধরনের পাগলামো, বল তো? অন্তু জানে এসব?’
নীরা অসহায় কন্ঠে বিড়বিড় করল,
‘ অন্তু বা ওর পরিবার কেউই বাচ্চাটাকে চাই না নমু। ওর আসা ঠিক হবে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে ওর আসা উচিত নয়।’
নম্রতা অবাক হয়ে বলল,
‘ অন্তু বাচ্চা চাইছে না? ও এমনটা বলেছে তোকে? আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না! দাঁড়া, আমি ওই ফাজিলটার সাথে কথা বলছি…. ‘
নম্রতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই উদভ্রান্তের মতো বলল নীরা,
‘ না। খবরদার অন্তুকে কিছু বলবি না। অন্তুকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তুই আমায় হেল্প করবি কী-না বল। হেল্প না করলে সরাসরি বলে দে। এসব নাটকের প্রয়োজন নেই। আমি নিজে নিজেই ম্যানেজ করে নেব।’
নম্রতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। নীরার শুকনো মুখটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। নীরার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই বুঝতে পারল, তার অস্থির লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। স্পষ্ট কিছু চিন্তা করা যাচ্ছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে, বন্ধুদের অভাববোধটা তীক্ষ্ণ ফলার মতোই বুকে গিয়ে বিঁধল নম্রতার। আজ নাদিম, রঞ্জন থাকলে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত না। নাদিমের মাথায় নিশ্চয় কোনো সমাধান থাকত? অথবা রঞ্জনের কথার ভাঁজে? নম্রতা হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দূর দূর ভেবেও কোনো সমাধান না পেয়ে দপ করে বসে পড়ল পাশের এক চেয়ারে। নম্রতার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই দৌঁড়ে গিয়ে বার দুয়েক বমি করল নীরা। দুইবার বমি করেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখ। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেল শরীর। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল ফ্লোরে। দুইহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘ প্লিজ নমু! একটু হেল্প কর। প্লিজ!’
নম্রতার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে দ্রুত ভাবার চেষ্টা করল। নাহ! কোনো সুন্দর সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। নম্রতা উঠে দাঁড়াল। নীরাকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে স্থির চেয়ে রইল নীরার মুখে। এতো এতো দুশ্চিন্তায় শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। নম্রতা জোরে জোরে শ্বাস নিল। এদিক-ওদিক পায়চারি করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সম্ভাব্য কোনো সমাধান ভাবার চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে নাদিম, রঞ্জনের সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। ছোঁয়া অস্ট্রেলিয়ায়, তার থেকেও কোনো সাহায্য আশা করা যায় না। নীরার শ্বশুর বাড়িতে কী চলছে তাও নম্রতা জানে না। অন্তুর মনোভাবের ব্যাপারেও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। সুতরাং হুট করেই অন্তুকে ফোন করা যাবে না। কোনো অপশনই সচল না দেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল নম্রতা। হঠাৎ আরফানের কথা মনে পড়তেই শেষ ভরসা হিসেবে আরফানকেই ফোন লাগাল সে। আরফান ফোন তুলতেই কিছুটা দূরে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ আপনি কোথায়?’
‘ কোথায় আবার? হসপিটালেই আছি।’
নম্রতা অস্থির কন্ঠে বলল,
‘ হসপিটাল! হ্যাঁ, আমিও হসপিটালেই আছি।’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ ভোররাতেই তো কথা হলো। হসপিটালে আসবেন, বলেননি তো।’
‘ তখন কী জানতাম যে এমন বিপদে পড়ব?’
আরফান ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘ বিপদ মানে? কী হয়েছে? ঠিক আছেন আপনি? কোথায় আছেন এখন? আমি আসছি।’
‘ উফ ডক্টর! আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিকঠাক আছি। সমস্যাটা আসলে নীরাকে নিয়ে। শুধু সমস্যা নয় ভয়ানক সমস্যা।’
আরফান এবার শান্ত হলো। স্বভাবসলুভ গাম্ভীর্যের সাথে বলল,
‘ ভয়ানক সমস্যাটা কী?’
নম্রতা প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘ নীরা প্রেগন্যান্ট।’
আরফান বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ এই কথাটা এতো ফিসফিস করে বলার কী আছে নম্রতা? নীরা বিবাহিত। বিবাহিত মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে ভয়ানক সমস্যা কিছু তো দেখছি না।’
নম্রতা অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ আমার কথাটা ধৈর্য নিয়ে না শুনলে সমস্যাটা বুঝবেন কীভাবে? এতো এতো ভিজিট নিয়ে রুগী দেখেন অথচ ধৈর্য বলতে কিচ্ছু নেই। এইজন্য আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার এই অবস্থা!’
‘ আপনি আবার আমার ভিজিট নিয়ে ফোঁড়ন কাটছেন নম্রতা!’
নম্রতা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় কথাবার্তা সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মেইন পয়েন্ট ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নম্রতা সরাসরি প্রসঙ্গ টেনে বলল,
‘ নীরা অ্যাবোরশন করতে চাইছে। ওর শরীরের কন্ডিশনও খুব একটা ভালো লাগছে না। আমি কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ডক্টর।’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ এটা না ওদের ফার্স্ট বেবি? ওদের তো খুশি হওয়া উচিত। তা না হয়ে, অ্যাবোরশন করবে কেন? ওর হাজবেন্ড মানে আপনার ফ্রেন্ড কোথায়?’
‘ অন্তু যে কোথায় তা আমি নিজেও জানি না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না। এতো প্রশ্ন না করে, দ্রুত একটা সমাধান দিন ডক্টর। আমার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। প্রেশার ফল করছে। জ্বর জ্বর লাগছে। এই টেনশন বেশিক্ষণ চললে নির্ঘাত হার্টফেল টার্টফেল করে ফেলব ডক্টর।’
‘ হার্টফেল করার প্রয়োজন নেই। নীরাকে নিয়ে আমার চেম্বারে আসুন। আমি দেখছি। অযথা টেনশন করে অসুস্থ হবেন তো খবর আছে।’
_
আরফানের চেম্বারে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে নীরা। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে। দৃষ্টি অস্থির। আরফান পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে নীরার মুখের দিকে চাইল। খুব সূক্ষ্ম চোখে খেয়াল করল, মেয়েটির শরীর কাঁপছে। ভীষণ ভয়ে হাসফাস করছে। দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় শুকিয়ে গেছে মুখ। আরফান হালকা কেশে বলল,
‘ পানি খাবে?’
নীরা আরফানের দিকে তাকাল। কাঁপা হাতে গ্লাসটা নিয়ে চুপ করে বসে রইল, চুমুক দিল না। কম্পনরত ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল কোলের উপর রাখা নিস্তেজ হাতে। নম্রতা অধৈর্য চোখে একবার আরফান তো একবার নীরার দিকে তাকাচ্ছে। আরফান বেশ রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল,
‘ নম্রতা বলছিল, তুমি অ্যাবোরশন করতে চাইছ। সত্যিই চাইছ?’
নীরা চোখ তুলে তাকাল। পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিয়ে মৃদু মাথা নাড়ল।
‘ কিন্তু কেন চাইছ?’
নীরা উত্তর দিল না। আরফান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ দেখো নীরা, তুমি যে কাজটা করতে চাইছ তা আইনত অপরাধ। আমাদের দেশে বহু অপরাধ হচ্ছে। তুমি আরেকটি অপরাধ করলে দেশের উন্নতিতে আহামরি কোনো সমস্যা হবে না। যা সমস্যা হওয়ার তোমারই হবে।অনেক সময় দেখা যায় অ্যাবোরশনের পর অনেকেই মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সেকেন্ড টাইম প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন দেখা দেয়। অনেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য মারাও যায়। সবার ক্ষেত্রে এমন হয়, তা নয়। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে নিজেদের দিকটা ক্লিয়ার রাখা জরুরি। কাজটা যেহেতু অনৈতিক এবং ডাক্তারদেরও রিস্ক নিয়েই করতে হচ্ছে সেহেতু টাকাও লাগবে প্রচুর। কমপক্ষে চার থেকে সাত হাজার টাকা। ঘাবড়ে যেও না, এসব ছিল ডাক্তারী কথা।’
নীরা দ্বিধান্বিত চোখে চেয়ে রইল। আরফান একটু থেমে বলল,
‘ ডাক্তারী কথা পাশে রেখে শুভাকাঙ্ক্ষী বা বড় ভাইয়ের মতো কিছু কথা বলি নীরা? আমি জানি না তুমি কেন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের জন্য তোমাকে আফসোস করতে হতে পারে। এটা তোমার প্রথম প্রেগন্যান্সি। মাতৃগর্ভে নিশ্চিন্ত থাকা প্রাণটির পৃথিবীতে আসার পূর্ণ অধিকার আছে। অনাগত সন্তানটাকে পৃথিবীতে আসার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি ফিরে শান্তি পাবে নীরা? আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি। আজকে এই ঘটনাটা ঘটে গেলে জীবনের বাকি রাতগুলো তুমি ঘুমোতে পারবে না।আফসোস আর তীব্র অপরাধবোধে জীবনের কোনো পর্যায়েই শান্তি পাবে না। পার্সোনালি এবোরশন বিষয়টা আমার পছন্দ নয়। তবুও আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু তার আগে, তোমায় ভাবতে বলব। তুমি একটু সময় নিয়ে ভাবো নীরা। তোমার হাজবেন্ডের সাথে আলোচনা করো। তাছাড়া তোমার শরীরের কন্ডিশনও সন্তোষজনক মনে হচ্ছে না। এই অবস্থায় এবোরশন করা সম্ভব নয়৷’
এটুকু বলে থামল আরফান। নম্রতাকে একবার দেখে নিয়ে খুব সাবধানে জিগ্যেস করল,
‘ এনিওয়ে, তোমার হাজবেন্ড কী পুরো ব্যাপারটা জানেন নীরা? তাকে বলেছ?’
নীরা অসহায় চোখে তাকাল। আরফান নরম কন্ঠে বলল,
‘ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ব্যাপারটা তাকে জানাওনি। কিন্তু জানানো উচিত ছিল। বাচ্চাটা তোমার একার নয়। বাচ্চা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বাবা-মা দুজনেরই সমান। তুমি কী কোনো সমস্যায় পড়েছ নীরা? সমস্যাটা খোলে বলো। আমাকে বলতে সমস্যা হলে এটলিস্ট নম্রতাকে বলো।’
নীরা ভয়ার্ত চোখে তাকাল। ক্ষণিকের মাঝেই টলমল করে উঠল চোখ। পাতলা ঠোঁটদুটো ভেঙে এলো কান্নায়। হঠাৎই দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। অস্পষ্ট কন্ঠে আওড়াতে লাগল,
‘ আমি আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাইনা ভাইয়া। চাইনা। ও বেঁচে থাকুক। অনেক বছর বাঁচুক।’
নম্রতা উঠে গিয়ে দুই হাতে আগলে নিল তাকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্ত করার চেষ্টা করল। আরফান তাকে সামলে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। নীরার হাত-পা ক্রমাগত কাঁপছে। নীরা যে ভাবনাচিন্তা না করে মানসিক চাপের মুখে হঠাৎই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তা বেশ বুঝতে পারছে আরফান। নীরা কিছুটা শান্ত হতেই বলল,
‘ তাহলে অ্যাবোরশনের কথা ভাবছ কেন?’
নীরা উদভ্রান্তের মতো চাইল। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ আমার সবকিছু এলোমেলো লাগছে ভাইয়া। রোজ রোজ অন্তুর মুখে বাচ্চা নিয়ে অসন্তোষ। সাংসারিক টানাপোড়েন, দুশ্চিন্তা, শাশুড়ি মায়ের বিতৃষ্ণা এসব দেখে দেখে মনে হচ্ছিল অ্যাবোরশন ছাড়া উপায় নেই। আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি স্পষ্ট কিছু ভাবতে পারছিলাম না। এমন একটা পরিস্থিতিতে কনসিভ করেছি শুনলে কেউ খুশি হবে না ভাইয়া৷ অন্তু হয়তো রাগারাগি করবে। বড় ধরনের ঝামেলা হবে। হঠাৎ মনে হলো বাচ্চাটাকে এই ঝামেলার সংসারে আনা উচিত হবে না। সবাই নিশ্চয় তার সাথে ‘আনওয়েন্টেট’ বাচ্চার মতো ট্রিট করবে। বার বার মনে হচ্ছিল, ওর ভবিষ্যৎ কী হবে? কিভাবে কী হবে? আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না।’
আরফান শান্ত চোখে চেয়ে রইল। নীরার এলোমেলো কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ সবকিছু এতো নেগেটিভভাবে কেন ভাবছ নীরা? এতো প্রেশারই-বা কেন নিচ্ছ? প্রেশার নেওয়ার জন্য অন্তু আছে। ট্রাস্ট মি, এই অসাধারণ খবরটা শুনলে বিন্দুমাত্র রাগ করবে না অন্তু। আমি নিজে একজন পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, বাবা হওয়ার মতো আনন্দের খবর আর কিছু হতেই পারে না। অন্তুকে এতোবড় সারপ্রাইজ থেকে বঞ্চিত করো না। তাকে বাবা হওয়ার অনুভূতিটা অনুভব করতে দাও। আর ঝামেলার কী আছে?কোনো ঝামেলাই কী সারাজীবন থাকে? আর্থিক টানাপোড়েন আজ আছে, কাল থাকবে না। কিন্তু সেই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে বাচ্চাটাকে হারিয়ে ফেললে, তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সাংসারিক চিন্তা ছেড়ে শুধু বাচ্চাটার কথা ভাবো। মা হওয়ার অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতিটা উপভোগ করো। যে তোমার মাঝে আছে তার কাছে এখন থেকেই তুমি সুপার উইমেন। সে এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, তার মা তাকে সব ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। তার মা কী তার বিশ্বাসটা ধরে রাখবে না? ওর জন্য এসব ছোটোখাটো প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসতে পারবে না? এসব অযৌক্তিক চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো নীরা। এমন পাগলামো সিদ্ধান্ত তোমায় শোভা পায় না।’
নীরা আচ্ছন্নের মতো কাঁদতে লাগল। দুশ্চিন্তার ঘোরে এমন একটা বিশ্রী সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অপরাধবোধে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে মন। সে-ই বা কী করবে? বারবার মুড সুয়িং হচ্ছিল। শারিরীক দুর্বলতা আর এতো এতো দুশ্চিন্তায় স্পষ্ট কোনো ভাবনা আসছিলই না। সরি বাবু! মা সরি! হঠাৎ করেই অন্তুর ব্যাপারটা মাথায় এলো নীরার। আরফানের কথাটা যদি সত্য হয়, তবে নিশ্চয় অ্যাবোরশনের কথাটা শুনলে ভয়ানক রেগে যাবে অন্তু? নীরাকে একদম খুন করে ফেলবে সে! নীরার আবারও কান্না পেয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড অপরাধবোধ আর ভয়ে চারপাশটা কেমন অসহায় লাগছে।
#চলবে….
[ রি-চেইক করা হয়নি]