রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২৯
#লেখিকা — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
_________________
কাল ইদ। ইদুল আযহা। সেই উদ্দেশ্যই আম্মুর নানু বাড়ি থেকে সরাসরি গেলাম দাদুবাড়ি। এই করোনা পরিস্থিতির জন্য ডিসিশন নেওয়া হলো আব্বু আর মামু একসাথে কুরবানি দেবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়, কোরবানিটা আসলে দেবে কোথায়? নানু বাড়ি ময়মনসিংহ? নাকি দাদুবাড়ি শেরপুরে? আমার নানা-নানি বেঁচে নেই সেই অনেক বছর। নানু বাড়িতে মামু ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। অন্যদিকে আমার দাদু-দিদাও মারা গেছে অনেক বছর হলো। কিন্তু দাদু বাড়িতে আমরা ছাড়াও তিন কাকু আর ফুপিরা আসছেন ইদে। তাদের রেখে ময়মনসিংহে ইদ করাটা আব্বুর কাছে আকাশসম পাপ….
মহাপাপ! বাবা-মার অবর্তমানে ছোট ভাই-বোনদের রেখে ইদ করবেন? এটা আদৌ সম্ভব? কখনো নয়। একদমই নয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মামুর কুরবানিটাও এবার আমাদের সাথে আমাদের দাদুবাড়িতেই দেওয়া হবে। সেই হিসেবে মামুরাও এলো গ্রামের বাড়ি। আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছন উঠোনের নিচ থেকেই বন্যার পানির বহর। নিচু রাস্তাটা তখন বন্যায় প্লাবিত হয়ে খেয়া ঘাটের রূপ নিয়েছে পুরোদমে। বাড়ির মহলও বেশ ভরাটে।
কাকাতো-ফুফাতো ভাইবোন আর আমরা মিলে হৈ-হুল্লোড় কান্ড। তারওপর বন্যায় প্লাবিত কিছু লোকজনও এসে উঠেছে আমাদের পুরোনো চৌচালাটাই। সব মিলিয়ে বাড়িতে যেন মানুষ জনের অভাব নেই। বড় বড় সসপেন ভর্তি রান্না হচ্ছে। কাকিমনি,আম্মু, ফুপিরা মিলে পিঠে বানাচ্ছেন। আর আমরা? পাশের বাজারের দোকানগুলো চষে খাচ্ছি। আর এই সবকিছুর খরচ উঠাচ্ছেন ছোট চাচ্চু। প্রতিবার এমনই হয়। সব কাজিনরা মিলে যখন ইচ্ছে যা ইচ্ছে কিনে আনি আর শেষ দিনে সে সবের দম চুকিয়ে দেন ছোট চাচ্চু। এতো দিনে এটা যেন আমাদের জন্য একটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে ।
সে যায় হোক, শুভ্র ভাইয়ের জন্য এ বাড়িতে কুরবানির ইদ এটাই প্রথম। সবাই তাকে পেয়ে খুশিও ব্যাপক। শুভ্র ভাই বরাবরই আড্ডা জমাতে মহা ওস্তাদ। এবারও তাই হলো। মেহেদী দেওয়ার পাট চুকিয়ে রাত বারোটা নাগাদ ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় আড্ডা দিতে বসলাম সবাই। উদ্দেশ্য ঘুমানোর সমস্যা নিয়ে জর্জরিত এই রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেওয়া। রাফিয়া ছুটে গিয়ে একটা পেপসির বোতল এনে বললো “ট্রুথ এন্ড ডেয়ার” খেলবে।
সবার সম্মতিতে খেলাটা শুরুও হলো। এক পর্যায়ে বোতলের মুখটা শুভ্র ভাইয়ের দিকে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। ভেতরের ঘর থেকে আব্বুর এক দফা ধমকও খেলো। কয়েক সেকেন্ড নিরবতা পালন করে আবারও উত্তেজনায় ফেটে পড়লো সবাই। শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খানিকটা হাসলেন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বললেন,
—” কাহিনী কি বুঝলাম না। আমার সময় সবাই এমন নাচতেছিস কেন?”
আলিফ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললো,
—” সেটা একটু পরে বুঝবে। তো ট্রুথ অর ডেয়ার?”
শুভ্র ভাই হেসে বললো,
—” ট্রুথ।”
সবাই আশাক্ষুন্ন হয়ে উনার দিকে তাকালো। আপু বললো,
—” এটা কি হলো? আপনার তো ডেয়ার নেওয়ার কথা ছিলো শুভ্র ভাই। খুব তো বলেন আমি বীর পুরুষ, বীর পুরুষ। এখন কই গেলো বীরত্ব? ভিতু একটা।”
—” কানের নিচে চড় না খেতে চাইলে চুপ যা। তুই বললেই তো আর ভিতু হয়ে গেলাম না আমি। তোদের পাল্লায় পড়ে নিজের ইমেজ নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। বড়দের চোখে “শুভ্র অলওয়েজ আ গুড বয়।” সো ট্রুথ!”
সবাই কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে রইলো। ফিসফাস শেষ করে বেশ মুড নিয়ে বলে উঠলো রাফিয়া,
—“ভাইয়া? আপনি তো টোটালি ঢেকে রাখার মতো মানুষ। আপনার জিএফ আদৌ আছে কি নাই তা বহুত অনুসন্ধান করেও ধরতে পারি নি আমি। তো…আপনার ট্রুথটা হলো, আপনার যদি এমন কেউ থেকে থাকে তাহলে তাকে দেখামাত্রই আপনার মনে কোন কথাটা প্রথম জাগে। আই মিন, ফাস্ট ফিলিংসটা কেমন হয় সেটা…”
রাফিয়া কথাটা শেষ করার আগেই চট করেই উত্তর দিলেন শুভ্র ভাই,
—” চলো না বিয়ে করি।”
রাফিয়া থতমত খেয়ে বললো,
—” জি?”
শুভ্র ভাই ইনোসেন্ট লুক নিয়ে বললেন,
—” তাকে দেখলে আমার বারবরই এই একই ফিলিংস হয়। “চলো না বিয়ে করি” টাইপ ফিলিংস।”
আলিফ ভাইয়া হেসে বললেন,
—” ভাই? তোমার হবু শশুড়কে বলতাম বিয়ের কথা?”
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
—” বলে ধন্য কর ভাই। সাথে আমার হবু বউয়ের হবু শশুড়কেও বলিস যে তার হবু বউমার হবু বর বিয়ে করতে চায়। ”
আলিফ ভাইয়াসহ সব ভাইয়ারাই হেসে উঠলেন। রাফিয়া দ্বিধান্বিত চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
—” আলিফ ভাইয়া তুমি শুভ্র ভাইয়ার হবু শশুড়কে চেনো?”
পাশ থেকে মাহিন ভাইয়া আমোদিত গলায় বললো,
—” না চিনলে শুভ্র ভাইয়ের থেকে ঠিকানা নিয়ে চিনে নেবো। সাথে ভাবির হাতের রান্নাও খেয়ে আসবো। শুভ্র ভাইয়ের বউ বলে কথা রান্না তো অবশ্যই পারবে। বেশি না আমাদের রোদুর মতো রান্না পারলেই চলবে। কি বলো শুভ্র ভাই, চলবে না?”
শুভ্র ভাই হাসলেন। রাফিয়া ঠোঁট উল্টে বললো,
—” ধুর! আমি আরো ভাবলাম শুভ্র ভাই রোমান্টিক টাইপ কিছু বলবে। কিন্তু আমি আশাহত। উনি তো সরাসরি বিয়েতে গিয়ে ওখানেই স্টপ হয়ে গেলেন।”
শুভ্র ভাই সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
—” বাচ্চা মেয়েদের এতো ভাবা ভালো না। আমি খুবই ভদ্র ছেলে তাই আমি সবসময় ভদ্র ভদ্র জিনিসগুলোই ভাবি। আমার মতো ভদ্র ছেলেকে নিয়ে এমন অভদ্র চিন্তা এলো কি করে তোমার? ছি!”
রাফিয়া অসহায় মুখ করে তাকালো। আমি প্রথম থেকেই অনুভূতিশূন্য ভাব নিয়ে বসে ছিলাম। এখনও তেমন ভাব নিয়েই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলাম। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ দুটো খানিকটা বুজতেই ফোনে ম্যাসেজ টুন বেজে উঠলো। অলস হাতে ফোনটা হাতে নিতেই শুভ্র ভাইয়ার ম্যাসেজ চোখে পড়লো,
—” পা ব্যাথা?”
আমি ম্যাসেজের উত্তর না দিয়ে ফোনটা পাশে রাখতে নিতেই আবারও ম্যাসেজ এলো,
—” বেশি ব্যাথা করছে?”
ম্যাসেজটা এক পলক দেখে ফোনটা উল্টে রেখে চোখ বন্ধ করলাম। এটা আমার মুড সুয়িং গত সমস্যা। হুটহাট কারো সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া, ম্যাসেজ- কল ইত্যাদিতে রেসপন্স না করা সবকিছুই আমার বয়সগত অভ্যাস। চোখ দুটো বুজে নিতেই রাজ্যের ঘুম ভর করলো আমার চোখে। আজ পা’টা সত্যিই খুব বেশি ভুগচ্ছে আমায়। এই ভুগান্তিটা আমি ছাড়া দ্বিতীয় কারো বুঝার উপায় নেই। তবুও উনি কিভাবে বুঝে গেলেন, কে জানে? আমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসার পাঁচ মিনিটের মাথায় বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন মামানি। ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠলেন,
—” রোদু কই? রোদু?”
আমি চোখ মেলে তাকালাম। মৃদু গলায় বললাম,
—” এই যে আমি। কিছু বলবে?”
মামানি তাড়া দিয়ে বললেন,
—” তোর নাকি পা ব্যাথা করছে? রাতে ওষুধ খেয়েছিলি? ভেতরে আয়। আমার পাশে জায়গা আছে ওতো তোর হয়ে যাবে। আয় শীগগির।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ উঠে চলে গেলাম রুমে। রুমে যাওয়ার আগে একবার আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মাহিন ভাইয়াদের সাথে গল্পে মত্ত এই শুভ্রকে যতবার দেখি ততই অবাক হই আমি। লোকটা ভীষণ অদ্ভুত।আশেপাশে না থেকেও যেন খুব অদ্ভুতভাবে আমার আশেপাশেই থাকেন উনি। কিছু না করেও যেন অনেক কিছু করেন। অনেক কিছু!
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। পা ব্যাথায় শরীর মন সবই যেন বিষিয়ে উঠছে। বারান্দার পাশের রুমটাতে শোয়ায় বারান্দার চিল্লাপাল্লাগুলো কানে অনেকটাই স্পষ্ট। আমি ছোট্ট করে শ্বাস টেনে নিয়ে ডান দিকে ফিরে শুতেই থেমে গেলো সব গোলযোগ। থমথমে এই নীরবতা কাটিয়ে ভরাট একটা কন্ঠ বেজে উঠলো কানে,
“হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য, আশায় হাত বাড়াই।
যদি কখনো একান্তে
চেয়েছি তোমাকে জানতে
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে
ছুটে ছুটে গেছি তাই।
এটুকু গেয়েই থেমে গেলেন উনি। একটু চুপ থেকে আবারও গাইলেন। তবে অন্য গান,
“Let’s fall in love for the night
And forget in the mornin’
Play me a song that you like
You can bet I’ll know every line
I’m the boy that your boy hoped that you would avoid…..”
মুহূর্তেই মৃদু হাসি ফুটলো আমার ঠোঁটে। চোখ দুটো বুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উনাকে বলতে ইচ্ছে হলো, ” আমি মিথ্যে বলেছিলাম শুভ্র ভাই। আপনার কন্ঠে ইংলিশ গানটা খুব একটা বাজে শুনাই না। অনেকটা মাদকের মতো শোনায়। ঘুম পাড়ানো মাদক!” কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই ঘুম নামক ক্লান্ত মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম আমি।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/