রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৫৬
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
কিছু কিছু সকাল খুব বিষণ্ণ হয়। বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ালে খাঁখাঁ করে উঠে শহর। ভোরের রোদে ঝলসে যাওয়া এই সুন্দর শহরটিকে হঠাৎ করেই খুব দুঃখী মনে হয়। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠে। অতৃপ্ত চোখদুটো অচেনা তৃপ্তি খুঁজে। মনে হয়, খুব শূন্য এই নগর। আশেপাশে কেউ নেই। কেউ না। কারো থাকার কথা ছিল। থাকলো না। হাসার কথা ছিলো। হাসলো না। কেমন মৃত লাগে এই বাতাস, এই আকাশ। সব থেকে মৃত লাগে এই প্রাঞ্জল শহরের পথ। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
বারান্দার রেলিঙে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই এক টুকরো মলিন রোদ আছড়ে পড়লো গায়ে, চোখের পাতায়। হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল রোজকার ব্যবহৃত কলম। আজ বহুদিন হলো আমি লিখতে পারছি না। শব্দগুলো বুঝি ফুরিয়ে গিয়েছে। থেমে থেমে, পৃথিবী হাতড়েও উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না অনুভূতির বহর। শেষ হচ্ছে না উপন্যাসের বিষাদ প্রহর। তবুও চেষ্টা করি। লিখে যাই। ব্যস্ত কলম আরও ব্যস্ত হয় একটি সমাপনী অধ্যায় টানার। তা সত্ত্বেও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়। নিজেকে প্রকাশ করতে পারার গুণটা খুব শক্ত গুণ। ভীষণ কঠিন কাজ।
শব্দের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে প্রকাশ করার দুঃসাহসও বড়ো দুঃসাহসিক দুঃসাহস। আর তা যদি হয় পুরোনো অনুভূতির খাঁজ তবে সেই দুঃসাহস করা, আমার মতো গোবেচারা সাধারণের জন্য ঘোর পাপাচার। তবুও কী মনে করে সেই পাপাচার করতে বসেছি। ডায়েরির ভাঁজে ভাঁজে লিখতে বসেছি আমার খুব গোপন গোপন কথা। যা আমি বলতে পারিনি, বুঝাতে পারিনি, কাউকে, কখনো। যে দুঃসহ জ্বালাগুলো কেবল আমার নিজস্ব, বড় লজ্জার।
এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে সেপ্টেম্বরের শেষটা লিখতে গিয়ে বুঝলাম, বহু স্মৃতি হারিয়ে গিয়েছে। ভুলে গিয়েছি অনেক অনুভূতির বহর। চোখ বন্ধ করলেই বেসুরে, সাদা-কালো এক শরৎ ভাসছে। যে শরৎ-এর সবটুকু রস শুষে নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন শুভ্র ভাই। পেছনে পড়েছিল কেবল আমি। আর আমার বর্ণহীন, একলা আকাশ। এক টুকরো বিবর্ণ বিকেল আর ‘আমি-তুমি’র শূন্য খাঁচা। বহুদিন আগে, কোনো এক গোধূলি সন্ধ্যায়, শুভ্র ভাই প্রচ্ছন্ন এক ধমকি দিয়ে বলেছিলেন,
‘রোদপাখির যদি কক্ষনো মন খারাপ হয় তবে আমিকে কেড়ে নিয়ে তুমিকে একদম একা করে দেব। মনে থাকবে?’
শুভ্র ভাই তার কথা রেখেছেন। তার রোদপাখির মন খারাপে ‘তুমি’ কে কেড়ে নিয়ে ‘আমি’কে একদম একা করে দিয়েছেন। খাঁচার ‘তুমি’ উড়ে যাওয়ার পর ‘আমি’ যেমন খুব নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেই গেলো। শুভ্র ভাই আর আমার গল্পের ‘আমি’র ও হলো ওই একই দশা। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শেষে মরেই গেল। শুভ্র ভাই চলে যাওয়ার পর ‘আমি’র খাঁচার মতো আমার প্রিয় শহর নামক খাঁচাটাও একদম ফাঁকা হয়ে গেল। সবকিছু কেমন পাল্টে গেল। কাজিনদের আড্ডায় ভিড় কমে গেল।
বাড়ির সামনের পথটা ফাঁকা হয়ে গেল। কড়া চোখের ভয় না থাকায় ফুরিয়ে গেল আমার সকল দস্যিপনার গল্প। চাওয়া-পাওয়া বন্দী হলো বুক পকেটের ছোট্ট এক খোপে। প্রথমবারের মতো উপলব্ধি হলো, সপ্রতিভতা খুব বাহানা। আমি আসলে কারো কাছে নিজ থেকে কিছু চাইতে পারি না। নিজের কথা বলতে পারি না। এমনকি আমার প্রিয় বাবার কাছেও না। আমার শরীর যেমন তার কথায় চলে। মন যেমন অবচেতনেও তাকেই ভাবে। ঠিক তেমনই একমাত্র সে’ই জানে আমার না বলা সকল কথা। মন খারাপের সকল সকল ব্যথা।
আমার এই ব্যথা আর বিষণ্ণতার গল্পটা যে কবে থেকে শুরু হলো, আজ আর মনে করতে পারি না। কবে থেকে এই আকাশ সমান বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম? কেন ডুবে গেলাম? কিচ্ছু মনে করতে পারি না। কেবল স্মৃতিতে ভাসে, আমি যেন হুট করেই একা বনে গেলাম। ভীষণ একাকিত্বের সাগরে ভাসতে ভাসতেই আজগুবি, ভুল চিন্তায় মগ্ন হলাম। পড়াশোনা, ভর্তি পরীক্ষা সব মাথায় উঠলো। শুভ্র ভাই আর আমার সম্পর্কের জটিল সমীকরণগুলো নিয়ে ভাবতে বসলাম। অনেক অনেক সময় গড়াল।
আমার একাকিত্ব, আমার আঁধার ঘরের আলো যখন একদম নিঃশেষ হয়ে এলো তখন গিয়ে আমি বিশ্বাস করে নিলাম। ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না। যা থাকে তা কেবল মোহ। অভ্যাস। জেদ। যে শুভ্রকে তাসনীমের মতো রূপবতী আটকে রাখতে পারেনি। তাসনীম আপুর জ্বলজ্বলে ক্যারিয়ার যাকে মুগ্ধ করতে পারেনি। সে আমাতে মুগ্ধ হবে কেন? তার চাওয়া-পাওয়ার ফটক তো আরও বিশাল হওয়া উচিত। অনেক অনেক বিশাল। সেই বিশালতায় কোথাও আমি নেই। ছিলাম না কখনো।
এই প্রথম! জীবনের এই প্রথম নিজের সকল আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তাসনিম আপুর সাথে রূপের পাল্লায় মাপলাম নিজেকে। মাপলাম তার বুদ্ধিমত্তার সাথে। স্মার্টনেসের সাথে। আর এক বুক হতাশা নিয়ে খেয়াল করলাম, রূপে-গুণে তাসনীম আপুর হাজার ভাগের এক ভাগও নই আমি। কিচ্ছু নেই আমার। কিচ্ছু না। শুভ্র ভাই রূপ-গুণহীন আমার পেছনে ছয় ছয়টা বছর নষ্ট করেছে, তাই যেন ভীষণ আশ্চর্য মনে হলো আমার। জীবনের প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করে ফেললাম, আমি শুভ্র ভাইয়ের একটা অপশন ছিলাম মাত্র। অবসরে নাড়াচাড়া করার মতো একটা কৌতুক।
নয়তো উনার মতো একজন মানুষ সারা দেশ হৈ হৈ করে ঘুরে, এতো রূপবতীর সহচরে এসে কিনা আমায় শুনাবে প্রণয়বার্তা? হাস্যকর! হাস্যকর! নিজের বোকামোতেই কী ভীষণ হাসি পেলো আমার। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে তলানীতে গিয়ে ঠেকলো। ভেসে গেল আত্মগরিমা। এতো ঘৃণা হচ্ছিল নিজের প্রতি! কিছু কিছু মানুষকে সৃষ্টিকর্তা রূপ-গুণ না দিলেও আত্মসম্মানবোধের ভারটা দেন খুব যত্ন করে। কেউ কেউ এই জ্বালায় জ্বলে উঠে। কেউ-বা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আমি এই আত্মসম্মানের যাতাকলে জ্বলেপুড়ে পিষ্ট হয়ে গেলাম।
শুভ্র ভাই আমাকে একটা অপশন ভেবেছে ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা হলো। প্রচন্ড ঘৃণা। এই ঘৃণা সহ্য করে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। আমি সামলে উঠতে পারছিলাম না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। এক টুকরো শ্বাস। একটু বুঝদার হাতের জন্য ছটফট করতে লাগলাম। আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে অনুশোচনায় পুড়ে যেতাম। ঘৃণা হতো নিজের চেহারার উপর। নিজের উপর। নিজের আমিত্বের উপর। ছি! ছি! ছি! কত সস্তা আমি।
শুভ্র ভাইয়ের ভাষায় নিশ্চয়, ফেলে দেওয়া জিনিস? তারপর থেকে বহুদিন আমি আয়নার সামনে দাঁড়ায়নি। শাড়ি পরিনি। এক ফোঁটা হাসিনি। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে দিন-রাত স্যোশাল মিডিয়ার নীল-সাদার দুনিয়ায় ডুবে থেকেছি। চোখের নিচে কালি পড়েছে। চেহারা ভেঙে গিয়েছে। বাচ্চাদের মতো গোল গোল গালদুটো হয়েছে অযত্নে ভঙ্গুর। গায়ের ওজন কমেছে হুহু করে। আর তখনই নীল-সাদার দুনিয়া আমায় দেখিয়েছে ভালোবাসা মানেই স্বার্থপরতা। নিউজফিড খুললেই পরকীয়া, অন্যায়, অত্যাচার, রূপের মোহ আর ভালোবাসা ভাঙার গল্প।
এই গল্পগুলো আমাকে দীর্ঘ বিষণ্ণতার দুয়ারে ছুঁড়ে দিলো আরও। পুরো পৃথিবীটাকে ভালোবাসাহীন, বিশ্বাসহীন নষ্ট ডোবা বলে বোধ হতে লাগল। সঙ্গীহীন বদ্ধ ঘর। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা নেগেটিভিটি। প্রিয়জন থেকে দূরত্ব। বিশ্বাসভঙ্গ। সব মিলিয়ে বিষিণ্ন এক বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম আমি। মানসিকভাবে এলোমেলো হয়ে গেলাম। ভালোবাসা, ভালোলাগা, আনন্দ, হাসি, কষ্ট এই অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে মুছে গেল। শুধু রইলো অদমনীয় রাগ। প্রচন্ড, প্রচন্ড রাগ। দরজার হালকা শব্দে রাগ হতো আমার। কারো মৃদু আওয়াজে চিড়বিড়ানো রাগে জ্বলে যেতো গা। ভালো কথা সহ্য হতো না। মন্দ কথা সহ্য হতো না। বস্তুত এই নষ্ট পৃথিবীর কিচ্ছুটি সহ্য হতো না আমার।
চারপাশের মানুষগুলোকে রিমোট চেপে মিউট করে দিতে ইচ্ছে হতো। নিজেকে যথাসম্ভব ঘরে আটকে রেখেও যখন আদিবা-জারিফের হৈ হৈ কানে আসতো। চিল্লাচিল্লি করে কাঁপিয়ে তুলতাম ঘর। হিংস্র আচরণ করতাম। বেপরোয়া হয়ে উঠতাম। বাবা,মা, আপু সবাই বিরক্ত হতে লাগল আমার উপর। পড়াশোনা করছি না অথচ এতো ঢং? আমার ব্যবহারে বিরক্ত হয়েই বুঝি বকাবকি, চিল্লাচিল্লি বেড়ে গেল আরও। কেন পড়ছো না? কেন খাচ্ছো না? কেন আমাদের জীবনটাকে এমন নরক বানিয়ে দিচ্ছো? অনেক অনেক প্রশ্ন ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে।
অথচ কেউ একটাবার আশ্বাস দিলো না। একটু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল না,’ নষ্ট পৃথিবীটাকে ভুলে যাও তো? আজকের দিনটা কেবল তোমার। আজ শুধু তোমার মন খারাপের গল্প শুনবো। বলো তো?কেন এতো মন খারাপ তোমার?’ ফুপ্পিদের কাছে আমাকে নিয়ে আম্মুর হাজারো আহাজারি শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙতো আমার। সারাদিনে হাজারও শব্দ, চিল্লাচিল্লিতে ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে আম্মুকে বলতাম,
‘আম্মু? একটু আস্তে বকো। একটু আস্তে কথা বলো। আমি আর পারছি না। এই শব্দ আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। প্লিজ, আস্তে! একটু আস্তে।’
আম্মু রেগে যেতেন। মেয়ের অদ্ভুত আচরণে বিরক্ত হতেন। অসহ্য হতেন। গলার জোর বেড়ে যেতো। আমি স্তব্ধ, অসহায় চোখে দেখতাম, আম্মু থামে না। শব্দেরা থামে না। আমার মাথার ভেতর অসহ্য ঝনঝনে শব্দগুলো থামে না। মাথা ফেঁটে যায়। পাগল পাগল লাগে। প্রচন্ড কষ্ট হয়। নিজেকে প্রকাশ করতে অপটু আমি ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে মুখে বালিশ গুঁজে চিৎকার করি। আমার গুমোট চিৎকার ঘুরেফিরে ফিরে আসে আমারই কাছে। চিৎকারগুলোও অসহায়, তাদেরও যে যাওয়ার জায়গা নাই।
আমি নতুন করে উপলব্ধি করি, আমাকে কেউ বুঝে না। এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা কেবল একজনকেই আমার আমিত্ব বুঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। দূর্ভাগ্যবশত, সেই একজন আমি নই। সেই একজন, একজন বিশ্বাসঘাতক পুরুষ। যে আমার চোখের প্রতিটি ঝলকানির ভাষা পড়তে জানতো। সে জানে আমার পছন্দ, অপছন্দ, অযথা মুড সুয়িংয়ের বৃত্তান্ত। কখনো বলা হয়নি তাকে।
তবু সে জানতো। সে আমার একমাত্র জাদুর মানুষ ছিলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দিনে দিনে আমার দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা সংখ্যা হারাল। কী থেকে কী হয়ে গেলাম আমি! আমার এমনই মানসিক বিপর্যয়ের মাঝে নতুন এক ঘটনা ঘটলো বাসায়। বাড়ির অন্দরে কোনো এক কারণে খুব হৈ হুল্লোড় হচ্ছিল। আমি শব্দ নিতে পারি না। মেজাজ তীক্ষ্ণ খারাপ। তার মাঝেই মা খুব মেজাজ দেখিয়ে আমার মুঠো ফোন বাজেয়াপ্ত করলেন। বই দেখিয়ে বললেন,
‘পড়ো। ফোন টোন বন্ধ। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে ফোন পাবে না।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিটি বাড়ির নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। কিন্তু তারা জানে না সবার জন্য যা স্বাভাবিক, আমার জন্য তা স্বাভাবিক না। মূলত আমিই স্বাভাবিক নেই। খুব গোপনে, কিছু একটা হচ্ছে আমার। আমি পাল্টে যাচ্ছি৷ সবার মাঝে থেকেও থাকছি না। হারিয়ে যাচ্ছি অথচ কেউ দেখছে না। এতসবের পরও মায়ের উগ্রতার বিপরীতে কিছুই বললাম না আমি। শান্ত রইলাম। মূলত, মার সাথে নতুন করে নতুন বিষয় নিয়ে ঝামেলা করার বিন্দুমাত্র শক্তিও শরীরে হচ্ছিল না। ঘন্টা তিনেক চুপচাপ পড়ে রইলাম। তারপর হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন। বুকের ভেতর দগদগ করে উঠল তীক্ষ্ণ এক জেদ। নিউরনে নিউরনে ফেঁটে পড়ল রাগ। নারকীয় রাগ। কেউ আমায় নিজের কথায় চালাচ্ছে, এই অধীনতাটুকুও আমি মেনে নিতে পারলাম না। মাকে গিয়ে বললাম,
‘ ফোন দাও।’
মা একটা জামা সেলাই করছিলেন। আমার কথা যেন শুনতেই পেলেন না এমনভাবে এড়িয়ে গেলেন। আমি শান্ত, শীতল কন্ঠে আবারও একই কথা বলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। মা এবারও কিছু বললেন না। মায়ের এই নিশ্চুপতাও আমার অহংবোধে তীব্র এক আঘাত হানলো। ঘেঁটে থাকা মেজাজটা আরও ঘেঁটে গেল।
সারা শরীরে ড্রাগের মতো ফেলতে লাগল রাগের আগুন। আমি নিজেকে শান্ত করতে পারলাম না। নিজের ঘরে ফিরে এসে টেবিলের যাবতীয় বইপত্র ছুঁড়ে ফেললাম। রাগে, বিরক্তিতে দপদপ করে উঠল মাথা। নিজের চুল টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। চিৎকার করলাম। কলমদানির সকল কলম, মার্কার পেইন, শখের সকল রঙ তুলি। সব সব গড়াগড়ি করতে লাগল মেঝেতে। নাহ, রাগ কমলো না। কিছুতেই রাগ কমছে না।
শরীরের রক্ত যেন ফুটছে আগ্নেয়গিরির মতো। আকাশসম রাগ কমাতে একটা বইয়ের পাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করলাম। কলমের নিপলটা খাতায় ঘঁষে ঘঁষে ভেঙেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত। আহ্! সেদিন কী পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি? কোনো সচেতন মানুষ এমন করে? এমন লজ্জাজনক কান্ড ঘটায়? কিন্তু রাগ যে কমে না। ড্রাগ আসক্ত মানুষের মতো থরথর করে কাঁপে আমার শরীর। বাবা বই প্রেমিক মানুষ। দরজায় দাঁড়িয়ে মেঘমন্দ্র কন্ঠে বললেন,
‘ বই ছিঁড়ে না, মা।’
আহা! মা! মা! কী মায়াময় ডাক! এই প্রথমবারের মতো বাবার মায়াময় ডাকে আমার রাগ কমলো না। শরীরের কাঁপন থামলো না। আমি আরেকটা বই ছুঁড়ে মারলাম দূরে। শরীর কাঁপছে থরথর। মস্তিষ্ক আর মনে তুমুল যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলছে বিপরীতমুখী দুই সত্তার। বাবা আবারও হিম শীতল কন্ঠে সাবধান করলেন আমায়,
‘ তোমাকে বই ছোড়াছুড়ি করতে নিষেধ করেছি। আর একটা বইও যেন ছোঁড়া না হয়। খবরদার। আমার বাসায় কোনো বেয়াদবি চলবে না।’
আমি তখন রাগে অন্ধ পৃথিবীর সব থেকে আদিম মানুষ। গায়েগতরে কেবল জেদ! জেদ! বাবা কথাটা বলে দরজা থেকে সরে যেতেই প্রচন্ড জেদে টেবিলের সমস্ত বই ছুঁড়ে ফেললাম আমি। মায়ের প্রতি রাগ নয়, বাবার প্রতি রাগ নয়, কীসের এতো রাগ আমার, নিজেই যেন ধরতে পারলাম না। নিজেকে থামাতে পারলাম না। বিবেকবান মনটা দূরুদূরু করছিল। অন্য এক হৃদয় ভীষণ বেপরোয়া হয়ে ছড়াচ্ছিল ভয়াবহ ধ্বংস তান্ডব। বুকের ভেতর একটাই গীত চলছিল বারবার, ‘ অসহ্য লাগছে। অসহ্য লাগছে। এভাবে বাঁচা যাচ্ছে না। শুনো পৃথিবী, এভাবে বাঁচা যাচ্ছে না।’ আমার এই বাঁচাটাকে আরও অসহ্য করে দিতেই আবারও নতুন এক ঘটনা ঘটলো।
জীবনে প্রথমবারের মতো আমার প্রিয় বাবা ছুটে এসে আমার গায়ে হাত তুললেন। আমার পৃথিবী যেন দুলে উঠল। আমার গালে, পিঠে দ্বিতীয় আঘাতটা না পড়া পর্যন্ত বিস্ময়ে ‘থ’ বনে গেলাম আমি। বাবা মারল! আমার বাবা আমায় মারল! কী আশ্চর্য! শুভ্র ভাই আমায় ছেড়ে গেলেন, বিশ্বাস করতে পারলাম। আমি যে নিতান্তই অকেজো তা বিশ্বাস করতে পারলাম। ঘরভর্তি মানুষের সামনে মা আমার আত্মসম্মান গুড়িয়ে গায়ে হাত তুলল, বিশ্বাস করতে পারলাম।
কেবল! কেবল, বাবা আমায় মারল এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। মুহূর্তকাল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বোধগম্য হলো। পৃথিবীটা বড়ো নিষ্ঠুর ঠেকলো। বুঝলাম, প্রিয় বাবার কাছেও প্রিয় মেয়েরা অসহ্য হয়! বিষাক্ত হয়। আমার পুরো পৃথিবী মিথ্যে হয়ে গেল। গায়ের রোমকূপ পর্যন্ত প্রতিবাদী হয়ে উঠল। নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়ল পাগল করা রাগ। অবিশ্বাস্য জেদ। আমি বাবার সামনেই বাকি বইগুলোও ছুঁড়ে ফেললাম। ড্রেসিং টেবিলের ফুলদানিটা ছুঁড়ে ফেলে বেপরোয়া হয়ে উঠলাম।
জীবনের প্রথমবারের মতো বাবার উপস্থিতি আমায় নমনীয় করলো না। আমি আমার প্রিয় বাবাকে হতভম্ব করে দিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়েই বাম হাতের কব্জিতে ভাঙা কাচের টুকরোয় নান্দনিক শিল্প আঁকলাম। ঢলঢলে লাল রক্তে ভরে গেল আমার হাত৷ নিউরনের আন্দোলন থেমে গেল। শরীর ক্লান্ত হয়ে এলো। বিশৃঙ্খল ঘরের এক কোণায় বাবাকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে দেখতেই আমি লুটিয়ে পড়লাম। মনে মনে বুঝলাম, আমার আর তাসনিম আপুর মাঝে কোনো ভিন্নতা নেই। আমরা দুজনেই এক। একই বিষে বিষাক্ত।
শুভ্র ভাই আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছেন জীবনের ওই একই মোড়ে। পান করিয়েছেন একই মৃত্যুবাণ গরল। আমরা অসহায়। আমাদের চালনশক্তি আমাদের হাতে নেই। একদম না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলেন মা।
আমার মা বুদ্ধিমতি, একটুও চেঁচামেচি করলেন না। লোক জড়ো করলেন না। নিজের মেয়ের এই অসম্মানটুকু, কলঙ্কটুকু নীরব আতঙ্ক অশ্রুতে চেপে গেলেন। জাহির করলেন না। বহুদিন পর, চুপচাপ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন আমায়। বোধহয় এই প্রথমবারের মতো বুঝলেন, তার মেয়ে ঠিক নেই। তার মেয়ের তাকে প্রয়োজন। খুব প্রয়োজন। কাতর মন বুঝি অভিযোগ করল, ‘আমার তো তোমায় আরও আগে প্রয়োজন ছিল মা। তুমি যে এলে না? কোথায় ছিলে? আমি যে শেষ হয়ে গেলাম? এখন উপায়?’ আমি চোখ বন্ধ করলাম। মস্তিষ্ক আর চাপ নিতে পারছে না। এখন একটু বিশ্রাম দরকার।
তারপর যখন চোখ খুললাম তখন বোধহয় মাঝরাত। মাথার উপর শা শা করে পাখা ঘুরছে। ঘরের আলো নেভানো। আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। আমার পাশেই মোড়া পেতে মূর্তির মতো বসে আছেন মা। কোমল হাতটা মোলায়েমভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার চুলের গোড়া। বহুদিন বাদে মা আমায় আদর করছেন। খুব খুব আদর করছেন। একটু বুঝি কাঁদছিলেনও? কী অবস্থা! অস্বস্তিতে ঘাঁট হয়ে গেল আমার শরীর। বিকেলে করা ওমন দূর্নিবার সিনক্রিয়েটের জন্য খুব লজ্জাও লাগল। প্রাণপণে চোখ বুজে পড়ে রইলাম।
আম্মুর দূরদর্শীতায় গতকাল ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার মৃদু হদিশও কেউ পেলো না। কেউ জানলো না আমার মানসিক বিপর্যয় আর কাটা হাতের কথা। সকালে চোখ মেলেই বামহাতের কব্জিতে বিশাল এক ব্যান্ডেজ চোখে পড়ল। আমি ব্যান্ডেজ হাতে চুপচাপ উদাস হয়ে বসে রইলাম। বাসায় এই নিয়ে কোনো হৈ চৈ হলো না। বাবা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। অভিমান আর অস্বস্তিতে আমিও বন্ধ করলাম বাক্যালাপ। ভাইয়া তো দূরের মানুষ।
আমি এতো কান্ড ঘটিয়ে ফেলার পরও তার মাঝে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। আমার ঘরে বন্দী জীবনটা এবার পাকাপোক্ত হলো। জীবনটা আটকে গেল শোবার ঘর আর আমি-তুমিহীন শূন্য বারান্দাটায়। মাঝে মাঝেই বারান্দায় গিয়ে ভাবতাম, এখান থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? কী হবে তাহলে? শরীর ফেঁটে রক্ত বেরুবে? অনেক অনেক রক্তে ভেসে যাবে পথ? যে পথটাতে শুভ্র ভাই আসতো-যেতো সবসময়? আমার এই দুর্ঘটনার খবর শুনে ভার্সিটি, ক্লাস ফেলে উড়ে এলো আপু। রাতের বেলা রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কী হয়েছে তোর?’
আমি চুপচাপ ফোনের জগতে ডুবে রইলাম। আপুর মাথায় চিড়বিড়ে রাগ। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তোর সমস্যাটা যদি আমাদের না বলিস তাহলে বুঝব কী করে? কী হয়েছে?’
আমি উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিজের অনুভূতিতে ভীষণ অগোছালো আমি খুব অস্বস্তিবোধ করলাম। আমি বরাবরই খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। সদা হাস্যরত, চঞ্চলা চপলা। সবার চোখে ভীষণ বর্হিমুখী সত্তা। কিন্তু আদতে বন্ধু-বান্ধব, সমবয়সী এমনকি আপুর সমস্যাগুলোও মন দিয়ে শুনে গোছালো সমাধান দিতে পারা অভ্যস্ত খোশমেজাজী মনটা কেন জানি নিজের বেলাতেই ঝুপ করে নিভে যায়। আমি কখনো আগ বাড়িয়ে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারি না। কারো প্রশ্নবাণে নিজের কষ্টের কথা বলতে পারি না। অস্বস্তি হয়। মনে হয়, এই কষ্টগুলো, সমস্যাগুলো কেবল আমার একান্ত। খুব নিজস্ব। এবারও তাই হলো। খুব অস্বস্তি নিয়ে বিরক্ত হলাম। বললাম,
‘ আমার আপাতত সমস্যাটা হলো, তোমার এই সকল প্রশ্নবাণ। ক্যান ইউ প্লিজ শ্যাট ইউর মাউথ?’
আপু প্রচন্ড রেগে গেলেন। রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকে না। শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলল,
‘ সরি, আই কান্ট। নিজেকে কী মনে করিস তুই? নিজের সমস্যা বলবি না অথচ আমাদের এতো টেনশনের মাঝে রাখবি। হাত কেটে ফেলেছিস। কী এতো কষ্ট তোর? কী করেছি আমরা? তোর ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে তোকে আমরা অত্যাচার করে করে মেরে ফেলছি……’
ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বহু সেন্টিমেন্টাল কথা বলে গেলো আপু। অনর্গল। তার রাগের মাঝে সে খেয়ালই করল না আমার প্রতিক্রিয়া পাল্টে যাচ্ছে। আমার মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। আমি তার প্রশ্নবাণ, চিৎকার, দখলদারি নিতে পারছি না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আমার বেপেরোয়া, আক্রমণাত্বক হৃদয়টা আবারও জেগে উঠছে। এই কয়েকদিনে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টার যে বাঁধটা ছিলো? সেই বাঁধটা ভেঙে যাচ্ছে। আমি বিরক্ত হলাম। অস্থির হলাম। হাতের কুশনটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে এলোমেলো করে ফেললাম কাঁথা, চাদর। দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
‘ হ্যাঁ করছো অত্যাচার। তোমাদের যন্ত্রণায় আমি শ্বাসটুকু নিতে পারছি না। গিভ মি আ লিটল বিট প্রাইভেসি, প্লিজ! নিজের চড়কায় তেল দাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’
আপু যদি তখনই থেমে যেতো? আমার কথাগুলো না ধরে আমাকে বুঝার চেষ্টা করতো? তাহলে বুঝি দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটা ঘটতো না। আপু আমার তালে তাল মিলিয়ে গলা তুলতে লাগল। আমার মাথা পাগল রাগটা আবারও ফিরে এলো। শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কপালে ঘাম ছুটলো। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে, পাশের টি-টেবিলের ড্রয়ারে রাখা বাবার গ্যাসের ঔষধের শিশিটা হাতড়ে নিলাম দ্রুত। অসহ্য! অসহ্য! এই অসহ্য দমবন্ধ থেকে মুক্তি চাই। এই দখলদারি, এই চেঁচামেচি থেকে মুক্তি চাই।
আপু যেন এক মুহূর্ত কিছু বুঝে উঠতে পারল না। আমি কেন ঔষধের শিশি নিলাম? কী করতে চলেছি? বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই চোখের পলকে ঔষধের শিশিটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। তারপর হতবাক চোখে চেয়ে রইল আমার রক্তিম মুখে। অল্প সময়ে অতিরিক্ত উত্তেজনায় হাঁপিয়ে উঠল আমার অসুস্থ মস্তিষ্ক। আমি দ্বিতীয়বারের মতো লুটিয়ে পড়লাম বিছানায়। ক্লান্তিতে, উত্তেজনায় ব্ল্যাকআউট হয়ে গেলাম দ্বিতীয়বারের মতো।
তারপর যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে সদা-স্বাভাবিক ঘুমের মাঝে পেলাম আমি। মাথার উপর পাখা চলছে শা শা। ঘরের আলো নেভানো। বুক পর্যন্ত কাঁথায় ঢাকা। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে উঠে বসলাম। বামহাতের কব্জিতে চিনচিনে ব্যথা করে উঠল একটু। হাতটা চেপে ধরে পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে সচেতন চোখে চাইতেই বুঝলাম, ঔষধের বাক্স, ছুঁড়ি-চাকু, কাঁচের জার এমনকি স্টিলের স্কেল পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হয়েছে আমার ঘর থেকে।
এমনকি আমার ডায়েরি লেখা কলমটাও। আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো। এরা কী ভাবে আমি সুইসাইড টুইসাইড করে ফেলব? আমি পাগল? আশ্চর্য! বিরক্ত হলাম। সত্যি বলতে ওমন অঘটন ঘটানোর কোনো সচেতন ইচ্ছে আমার ইহকালেও নেই। ছিলো না কখনো। কিন্তু ওই বিপদজনক অ্যাটাকটা যখন হয়….! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেদিনের পর থেকে বাসার পরিবেশ আরও নরম হয়ে গেল। চারদিকে সর্বদা পিনপতন নীরবতা। কেউ আমায় ঘাটায় না। ডাকে না। আমি আমার মতো বসে থাকি। চঞ্চলা চপলা থেকে হঠাৎ করেই একদম নিশ্চুপ প্রাণী হয়ে বেঁচে থাকি।
এক সময় আমি বাড়ি না থাকলে খা খা করতো অন্দরমহল, শূন্য লাগতো বাবার বুক। সর্বদা নিশ্চুপ থাকা ভাইও ফোন দিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে মারতো। অস্থির হয়ে যেতো। এখন আমি সর্বদা বাড়িতেই থাকি। তবুও বাড়িটা মৃত্যুপুরীর মতোই ছমছমে শূন্য। কোথাও কানে তালা লাগানো হাসির আওয়াজ নেই। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় নেওয়ার অভিযোগ নেই। চলতে চলতেই উল্টে পড়ায় কোনো শাসন নেই। সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে হুড়োহুড়ি নেই। মনে মনে বুঝি, আমার সাথে সাথে থেমে গিয়েছে অন্দরমহলের প্রতিটি প্রাণ। উচ্ছল হাসির নহর। ভাইয়া এখন আমার কাছে আসতে ভয় পায়। যদি হঠাৎ রেগে যাই? ভুল কিছু করে বসি? মা ব্যস্ত থাকেন। বাবা ভোগেন অনুতাপ আর মনোঃকষ্টে। আর আমি?
আমি অনুভূতিহীন মূর্তি মাত্র। এই অনুভূতিহীন চোখেই বুঝতে পারি, পুরো পরিবারের নিশ্চুপ মনোযোগে নিশ্চুপভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। ছাদে, বারান্দায় গেলে নিশ্চুপ চোখে অনুসরণ করে চলেছে প্রতিটি চোখ। যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলি? আতঙ্কে কাঁপে তাদের বুক। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একটা সময় গিয়ে মনে হলো, আমার বুঝি একটা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। এভাবে থাকলে আমি বাঁচতে পারব না। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই। আমি নিজেই নিজের সমস্যাগুলো বেছে বেছে সমাধানের চেষ্টা করতে লাগলাম। সবার আগে স্যোশাল মিডিয়া থেকে লম্বা এক ছুটি নিলাম। নিজেকে ফোন থেকে বহু দূরে রেখে বইপত্রে মন বসানোর চেষ্টা করলাম।
অক্টোবরের দুই কী তিন তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হলো। পরীক্ষা দিতে গিয়ে নতুন এক অঘটন ঘটলো। নিজের শহরে বসে পরীক্ষা। নার্ভাস হওয়ার মতো তেমন কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু প্রশ্নপত্র পাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম আমি। সেই মুহূর্তে আমি কী ভাবছিলাম, জানা নেই। অথচ মাথা ভর্তি কতশত চিন্তা আমার! অন্যমনস্কতা যতক্ষণে কাটলো ততক্ষণে ভয়াবহ এক ব্লান্ডার করে ফেলেছি। লিখিত প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে বরাদ্দ জায়গার বাইরে গিয়ে লিখে ফেলেছি উত্তর। আমার উদাসীনতা কেটে গেল।
নার্ভাস হয়ে পড়লাম। বুঝে ফেললাম, খাতা বাতিল হয়ে যাবে। অযথা লিখে লাভ নেই। গোটা পরীক্ষায় চুপচাপ বসে রইলাম আমি। হাত-পায়ে মৃদু কম্পন আর দপদপে মাথাব্যথা নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজেকে আমি আবারও ভীষণ অকেজো, অযথা বলে আবিষ্কার করলাম। এই ছোট্ট ব্যাপারটাও মনের উপর এতো বেশি প্রভাব ফেলল যে সেই ভয়ঙ্কর অ্যাটাকটা ফিরে ফিরে আসতে লাগল। ভাইয়া আম্মুকে ডাক্তারে নিয়ে যাওয়ায় আর বাবা ব্যস্ত থাকায় রাতুল ভাইয়া আর তন্নী আপুর সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে হয়েছিল আমায়। আমি হল থেকে বেরুতেই প্রশ্ন ছুড়লেন রাতুল ভাইয়া,
‘ প্রশ্ন কেমন হয়েছে? পরীক্ষা কেমন দিলি?’
আমার খুব অপরিচিত মাথাব্যথাটা সেদিন থেকেই শুরু হলো। আমি আরেকবার আবিষ্কার করলাম, আমি সত্যিই শুভ্র ভাইয়ের যোগ্য নই। আমি ফেলে দেওয়ার মতোই বস্তু। তলানীতে গিয়ে পৌঁছানো আমার আত্মবিশ্বাস আর ভেঙে টুকরো হওয়া আত্মসম্মানের জ্বালায় আশেপাশের কোনো কথায় কানে ঢুকলো না আমার। কানের কাছে ভাসতে লাগল কোনো এক প্রেতাত্মীর খেঁ খেঁ হাসি। অজস্র তিরস্কার।
আমি আমার দুর্বল মনটাকে, এলোমেলো মানসিকতাকে যতই একত্রিত করতে চাইলাম তারা যেন আরও ছড়িয়ে পড়ল। বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। বারবার বুঝিয়ে দিলো, আমার ব্যর্থতা! ব্যর্থতা! বুক ভরা অসহায়ত্ব নিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম আমি। হাত-পা ফ্যাকাশে হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ঠিক তখনই বাবা কল করলেন। বহুদিন পর বাবা আমায় মা বলে ডাকলেন,
‘ পরীক্ষা কেমন হয়েছে, মা?’
সেই মুহূর্তে আমার পৃথিবী ভেঙে কান্না পেলো। এক বুক অসহায়ত্ব আর আত্ম অপমান নিয়ে বললাম,
‘ আমার ভালো লাগছে না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও বাবা। আমি এক মুহূর্ত এখানে থাকব না।’
বাবা দ্বিতীয়বার আমায় পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করলেন না। কোমল কন্ঠে বললেন,
‘ বাবা তো এখন ময়মনসিংহ নেই মা। আলিফ তোমাকে বাসায় দিয়ে যাবে। ক্ষুধা পায়নি? কিছু খাবে? আলিফকে বলি ও কিছু কিনে দিবে।’
আমি অস্থির হয়ে বললাম,
‘ উঁহু। আমি শুধু বাসায় যাব। আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি বাসায় যাব। এক্ষুনি।’
বাবা অস্থির হয়ে আলিফ ভাইয়ার সাথে কথা বললেন। রাফিয়াও পরীক্ষা দিচ্ছে। আলিফ ভাইয়া জানালো রাফিয়া বেরুলেই বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। এক মুহূর্ত দেরী করবে না। রাফিয়া বেরুলো বেশ রয়ে সয়ে। তার পরীক্ষা চলনসই হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর অস্বস্তি নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরুতেই রাতুল ভাইয়ার কাছে থাকা আমার ফোনটা বেজে উঠল। নাহিদ ভাইয়া ফোন দিয়েছেন। বিরক্তিতে সারাটা শরীর রিরি করে উঠল আমার। কেন ফোন দেয় ওরা আমায়? কেন? কী চায়? রাতুল ভাইয়ার সামনে ফোন কেটে দেওয়াটা বড়ো অদ্ভুত দেখায় বলেই ফোন রিসিভ করলাম। নাহিদ ভাইয়া নরম কন্ঠে শুধালেন,
‘ পরীক্ষা কেমন হলো?’
পরিচিত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি। তবুও ভেতরটা তিঁতকুটে অনুভূতিতে ছেঁয়ে গেল। একদম মেপে মেপে বললাম,
‘ ভালো না। চান্স হবে না।’
পরীক্ষা খারাপ হওয়া নিয়ে নাহিদ ভাইয়ার মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। উনি খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
‘ ব্যাপার না। রাজশাহীর পরীক্ষা ভালো হবে। কাল আসছো তো রাজশাহী? পাঁচ তারিখ না তোমার পরীক্ষা? কয়টার বাস?’
আমি ক্লান্ত শ্বাস ফেললাম। এই দীর্ঘ মানসিক টানাপোড়েনে হাঁপিয়ে উঠে বললাম,
‘ সকাল নয়টার বাস।’
‘ তাহলে বিকেল তিনটের দিকে পৌঁছে যাওয়ার কথা৷ বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করব আমি। সাবধানে এসো।’
বুকের ভেতর অসহ্য এক অসহায়ত্বে হাসফাস করে উঠলাম আমি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোন কাটলাম। নাহিদ ভাইয়ের শেষ কথায় আকাশসম অনুভূতির হুল্লোড় আমার সহ্য হলো না। রাজশাহীতে পড়ার ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই উবে গেল। কাল সকালের বাসটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হলো।
রাজশাহী শহরটিতেই আর যেতে ইচ্ছে হলো না আমার। খুব অভিমান হলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি। কেন আমাকে নিয়েই এতো অনুভূতি থাকবে নাহিদ ভাইয়ার মনে? পৃথিবীতে কী অন্য কেউ ছিলো না? এই সাতশো সত্তর কোটি মানুষের পৃথিবীতে তার যোগ্য কী অন্য কেউ ছিলো না? আমার সাথেই কেন এতো কাকতালীয়তা? এতো অনুভূতির যুদ্ধ? ভীষণ ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো আমার। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই যাত্রাটা যেন কখনো শেষ না হয়। গাড়িটা যেন কখনও গন্তব্যে না পৌঁছায়। কোনো অনুভূতি, কোনো পরিচিত মুখের মুখোমুখি যেন না হতে হয় অনন্তকাল। আমার আর শক্তি নেই। অনুভূতির লড়াইয়ে আমি পরাজিত। আমাকে একটু শান্তি দাও।
বাসায় ফেরার পর পরীক্ষা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হলো না আমায়। আপু ফোন দিয়ে বোঝাল, ‘প্রথম পরীক্ষায় নার্ভাসনেস আসতেই পারে। ব্যাপার না। পরের পরীক্ষায় কনসেন্ট্রেট কর।’ আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বিষাক্ত মন নিয়ে বসে রইলাম। সকালে আমার রাজশাহীর বাস। পাঁচ তারিখ পরীক্ষা। নাহিদ ভাইয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানকার ডেপুটি কমিশনারের বাংলোতে। ডেপুটি কমিশনার নাহিদ ভাইয়ার মামা। সকাল বেলা ভাইয়া আর আমি বাসে উঠে যেতেই আমার মাথায় হাত রাখলেন বাবা। বাবা খুব অন্তমুর্খী মানুষ। অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন না খুব একটা। তবে সেদিন করলেন। বাসভর্তি মানুষের সামনেই মাথায় আলতো চুমু দিয়ে দূর্বোধ্য এক কথা বললেন,
‘ তুমি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আম্মু। নীতি-নৈতিকতা থেকেও বেশি। তুমি যা চাইবে বাবা তাই করবে। মন দিয়ে পরীক্ষা দাও।’
আমি বাবার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে পেলাম না। চুপচাপ বসে রইলাম। শেষ পর্যায়ে টিকেট কাটায় ভাইয়া আমার পাশে সীট পেলো না। আমাকে অপরিচিত এক ভর্তিচ্ছুর সাথে বসতে হলো। বাসে উঠার আগেই বমির টেবলেট খেয়ে নেওয়ায় বাস চলতে শুরু করতেই ঢুলুঢুলু ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভেঙে দেখলাম, ভাইয়া সীট থেকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ তুমি এমন দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
ভাইয়া যেন খুব লজ্জা পেল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ শরীর খারাপ লাগছে?’
আমি মাথা নাড়লাম। ভাইয়া শুধাল,
‘ কিছু খাবি?’
আমি আবারও মাথা নাড়লাম। ভাইয়া হতাশ হয়ে নিজের সীটে গিয়ে বসলো। আমি মাথা ঘুরিয়ে দুই একবার ভাইয়াকে উঁকি দিয়ে দেখে আবারও গহীন ঘুমে তলিয়ে গেলাম। আবারও যখন চোখ মেলে চাইলাম ভাইয়াকে একদম পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমি। আমার সীটে বেরিগেড দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ তুলে চেয়ে অবাক হয়ে বললাম,
‘ দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার সীটে কেউ বসে পড়েছে?’
ভাইয়া হাসলেন,
‘ না। রিজার্ভ সীটে কে বসবে?’
‘ তাহলে? সীটে যাও।’
‘ তোর যদি শরীর খারাপ করে? বাসে উঠে তো অভ্যাস নেই। তুই ঘুমো। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা হচ্ছে না।’
আমি ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলাম। উপলব্ধি করলাম, নিশ্চুপ মানুষের বুকে আস্ত এক ভালোবাসার পাহাড়। খুব আফসোস হলো। এতোগুলো মানুষের পৃথিবী সমান ভালোবাসা পেয়েও কেন এতো শূন্য আমি? কেন এতো মন খারাপ আমার? কেন আমার একজনকেই চাই? যেকোনো মূল্যে চাই। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বিষাক্ত মন খারাপেরা আবারও ছুটে এলো বুকে। ভাইয়ার গায়ে মাথা এলিয়ে আমি মনে মনে নিরন্তর বলে চললাম, মন খারাপ নেই। মন খারাপ নেই। আমার কোনো মন খারাপ নেই।
সদা শান্ত, চুপচাপ, অনুভূতি প্রকাশে অপটু ভাইয়া খুব ধীরে নিজের হাতটা রাখল আমার মাথায়। আমি দ্বিতীয়বারের মতো বুঝলাম, আমার মন খারাপ করার অধিকার নেই। সৃষ্টিকর্তা মন খারাপটা আমার জন্য বরাদ্দ করেননি। করার কথা নয়। তবুও বুক ফেঁটে যায় আমার। কোথাও একটা খাঁ খাঁ শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে বুক। অন্ধকার মন খারাপেরা ভয় দেখায় আমায়। আমি তাদের ভয় করি। ভীষণ ভয়। গোটা পথ ভাইয়া সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। রাজশাহী পৌঁছাতে পৌঁছাতে গোধূলি সন্ধ্যে নামল আকাশে। বাস থেকে নামতেই নাহিদ ভাইয়ার মামুর পাঠানো গাড়ির সন্ধান পেলাম।
মনে মনে এটুকু স্বস্তি পেলাম, নাহিদ ভাইয়া আসেননি। প্রায় আধঘন্টা গাড়ি যাত্রা শেষে নাহিদ ভাইয়ার মামুর বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম আমরা। সরকারি কর্মচারীতে ভর্তি এক বিশাল ফ্ল্যাট। চারদিকে হন্তদন্ত অস্থিরতা। এই হুলস্থুল ফ্ল্যাটে আমাকে নিজস্ব এক কামরা দেওয়া হলো। দেখা হলো, গুলুমুলু ছোট্ট এক বিস্ময় বালকের সাথে। টকটকে গৌড়বর্ণ নাদুস-নুদুস শরীর তার। একহাতে ধরা সক্রিয় ট্যাব। কার্টুন চলছে। বাচ্চাটি ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।
ভেতরে আসবে কি-না? গোল গোল চোখদুটোতে তা নিয়ে দেখা গেল বিশাল দ্বন্দ্ব। কিছুদিন আগেও আমি বাচ্চাদের সাথে খেলতাম। হাসাহাসি, দৌঁড়াদৌঁড়ি করতাম। অনেক অনেক গল্প বলতাম। কিন্তু এখন সব পাল্টে গিয়েছে। কোনো বাচ্চার সাথে ধৈর্য ধরে আলাপ চালানোর ধৈর্য এখন আর আমার নেই। বাচ্চাকাচ্চা বিরক্ত লাগে। কথা খুঁজে পাই না। তাই আর আগ বাড়িয়ে তার সাথে আলাপ করার আগ্রহ খুঁজে পেলাম না। একসময় বাড়ির কাজের লোকটি, যার দায়িত্ব কেবল বাচ্চাটাকে দেখে দেখে রাখা, সে দরজায় নক করল। আমি সাড়া দিতেই বলল,
‘ সকালকে একটু কাছে ডাকবেন ম্যাডাম? ওর আপনাকে ভালো লেগেছে। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। ঘুরে ঘুরে কেবল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে।’
আমি মৃদু হাসলাম। হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললাম,
‘ ভেতরে এসো। তোমার নাম কী? সকাল?’
সকাল খুব অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আমার দিকে ভুল করেও চাইল না। আমার থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে বসে চুপচাপ ট্যাবে কার্টুন দেখতে লাগল। আমি মনে মনে একটু স্বস্তি পেলাম। তাকে অযথা না ঘাটিয়ে চুপ করে রইলাম। খোলা ব্যালকণি থেকে হু হু করে বাতাস আসছে। সেই সাথে ঘুরে ঘুরে আসছে আমার ভীষণ অন্ধকার মন খারাপ। আমি প্রাণপণে এই অন্ধকার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলাম। এই অন্ধকারে আমার খুব ভয়। এই অন্ধকার আমায় পাগল করে দেয়। অন্য মানুষ করে দেয়। একা করে দেয়। এই অন্ধকার আমায় বাঁচতে দেয় না। এই বিষণ্ণ অন্ধকার আমার কন্ঠনালী চেপে ধরতেই গা ঘেঁষে বসল সকাল।
গোল গোল চোখদুটো মেলে আমার দিকে চেয়ে বাড়িয়ে দিলো হাতের ট্যাব। দেখাল সে কী দেখছে। আমি কী বলব কিছু বুঝতে না পেরে মৃদু হাসলাম। ভাইয়ার কিনে দেওয়া ব্যাগ ভর্তি চিপ্স, চকলেট থেকে একটা চকলেট বের করে সকালকে দিলাম। সকাল নিলো। কিছুক্ষণ আমার ওড়নার আঁচল চেপে ধরে বসে রইলো। সারা রুম জুড়ে লাফিয়ে কুদে একটু পর পর আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আবারও ছুটে গেল খেলতে।
সকালের এই ছটফটে চঞ্চলতায় অন্ধকার বিষণ্ণতাটুকু কাছে ঘেঁষতে পারল না আর। আমি দম নিলাম। লম্বা এক দম নিয়ে স্বস্তি পেলাম। খোলা ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে রইলাম নিরন্তর। বুকের ভেতর থাকা কাতর মন খুব কাতর হয়ে বলল, ‘ প্রিয় মন খারাপ? এবার..এবার আমি একটু স্বস্তি দাও।’ রাত আটটার দিকে নাহিদ ভাইয়ার মামু বাসায় ফিরলেন। চোখে-মুখে ডেপুটি কমিশনারের গাম্ভীর্যহীন বাবা বাবা স্পর্শ। আমাকে দেখেই এক গাল হেসে বললেন,
‘ কেমন আছো আম্মু? দেখো তো কী অবস্থা? তুমি এলে আর সকালের মা থেকে গেলো বাড়ির বাইরে। ওর ফ্লাইট কাল বিকেলে। আসতে আসতে রাত হবে। তোমাকে একদম নারীহীন তল্লাটে ফেলে দিলাম, তাই না?
আমি মৃদু হাসলাম। উনি বললেন,
‘রাজশাহীতে গরম গরম মিষ্টি পাওয়া যায়। চুলো থেকে সরাসরি সার্ভ করা হয়। খুব বিখ্যাত। চলো সবাই মিলে মিষ্টি খেয়ে আসি। এখানকার কালাইয়ের রুটিও খুব বিখ্যাত। আজকের ডিনারটা আমরা কালাইয়ের রুটি দিয়েই সারবো, কী বলো?’
আমি একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
‘ না মানে… কাল সকালে তো পরীক্ষা…এখন…।’
মামা আমার কথা শেষ করতে দিলেন না। আমার কথাটুকু হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ ধুর! এসব পরীক্ষা টরীক্ষা নিয়ে এতো চাপ নিতে হয় নাকি? আমি কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি। এইচএইচসি পাশ করে ঢাকায় পরীক্ষা দিতে গেলাম, হলো না। রাজশাহীতে এসে মসজিদে থেকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। দিলাম পরীক্ষা। কোনো চান্স নাই। আশা নাই। শেষমেশ আমাদের আনন্দমোহনে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। এখন আমি রাজশাহী জেলা চালাচ্ছি। পড়াশোনা নিয়ে অতো চাপ নেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ও কোনো বিষয় না। বিষয়টা হলো টেকনিক। টেকনিক বুঝতে হবে। চট করে তৈরি হয়ে নাও তো আম্মু। নাহিদকে ফোন দিয়েছিলাম। নাহিদ আসছে। ও আসলেই সবাই একসাথে ঘুরতে বেরুবো।’
আমার আপত্তি ডিপুটি কমিশনারের হুকুমের তোপে টিকলো না। তাঁর একটি হুঙ্কারেই গাড়ি ঠিক করতে দৌঁড়াদৌড়ি লেগে গেল। সবাই অস্থির ছুটছে। সকালও হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে। তার পেছন পেছন জামা-কাপড় নিয়ে ঘুরছে তার জন্য বরাদ্দ দু’দুটো কাজের লোক। কিছুতেই তাকে হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এতো মানুষের ভীড়ে, বাইরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়েই তৈরি হলাম। আমরা তৈরি হয়ে বেরুনোর আগ মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে পৌঁছালেন নাহিদ ভাইয়া। সকাল ছুটে গিয়ে তার কোলে উঠে বসল। ভাইয়ার সাথে স্বাভাবিক কুশলতা সেড়ে আমার দিকে চাইলেন নাহিদ ভাইয়া। নার্ভাস হেসে বললেন,
‘ কেমন আছো?’
আমি লৌকিকতার হাসি হেসে জানালাম,
‘ভালো আছি।’
নাহিদ ভাইয়া আর কিছু বললেন না। সকালকে নিয়ে ব্যস্ত রইলেন পুরোটা সময়। আমাদের এই কয়েকজন মানুষের ঘুরতে যাওয়া উপলক্ষ্যে আরও দ্বিগুণ মানুষের পাহারাদার দেখে মাথা চক্কর দেওয়ার জোগাড় হলো আমার। গুণে গুণে তিনটি গাড়ি প্রস্তুত হলো। সকালের উত্তেজনা আর ধরে না। আজ সে গাড়ি চালাবে। আমাকে বসতে হবে তার পাশে। আমি অবাক হয়ে শুধালাম,
‘ তুমি গাড়ি চালাতে জানো?’
সকাল গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ সে জানে। সকাল আমাকে টেনে একটি গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। আমি মৃদু মৃদু হাসি নিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো তার পাশে গিয়ে বসলাম। সে আমার হাত ধরে বসে রইলো। বামহাতটা নাড়তে নাড়তে খুব মন খারাপ কন্ঠে শুধাল,
‘ তোমাকে কে মেরেছে?’
আমি তার প্রশ্ন বুঝতে না পেরে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে চাইলাম। কব্জির উপর শুকিয়ে আসা কাটা দাগটির দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সকাল তার ছোট্ট হাতে আমার কাটা জায়গায় হাত বুলাল। নিজের মতো করে বলল,
‘ আমি বাবাকে বলব। আমার বাবা মারবে তাকে। তুমি মন খারাপ করো না।’
আমি তার মাথা ভরা চুলগুলো আলতো নাড়িয়ে দিয়ে মৃদু হাসলাম। সকালের সাথে টুকটাক ছেলেমানুষি আলাপ চলল। গাড়ি চলার আগ মুহূর্তে আমাকে অবাক করে দিয়ে ড্রাইভারকে নাকচ করে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলেন নাহিদ ভাইয়া। সকাল বসলো তার কোলের উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে বসে রইলাম আমি। মনের গহীনে খুব ঈর্ষান্বিত মানুষটির কড়া চাহনিটা বহুদিন পর খুব মিস করলাম।
উদাসীন মন খারাপগুলো ধীরে ধীরে আবারও কাবু করল আমায়। গাড়ির জানালায় ঠেস দিয়ে আবারও ভীষণ ভীষণ অন্ধকারে ডুবে গেল মন। কোথায় আছি? কী করছি? সব কেমন গুলিয়ে গেল। মধ্যরাতের বুক ফাঁটা কান্নাগুলো ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। তাকে ছাড়া! শুধুমাত্র ওই একজনকে ছাড়া গোটা দুনিয়াটা কেমন অন্ধকার বোধ হলো। খুব জেদ ধরে তাকে চাইতে ইচ্ছে করল। কিন্তু কার কাছে চাইব? কে এনে দিবে তাকে?
শুভ্র ভাই অবশ্য দিতো। তার কাছে আমার সকল আবদার আকাশসম গুরুত্বপূর্ণ। তাকে যদি বলতাম, আমার এই মুহূর্তে তাকে প্রয়োজন। সে নিশ্চয় চোখ রাঙাতো। খুব রাগ করার মতো কথা বলতো। অযথা ধমকি ধামকি করে অস্থির করে ফেলতো। লম্বা বেনুনি টেনে দিতো। বাবাকে নিয়ে খুব খারাপ খারাপ কথা বলতো। কিন্তু ঠিক ঠিক নিজেকে এনে দিতো আমার হাতের কাছে। স্বইচ্ছায় সমর্পন। নিজের অবুঝ চিন্তায় নিজেই হেসে ফেললাম আমি। ঠোঁটের কোণায় উদাসী কাষ্ঠ হাসি নিয়েই সেই মিষ্টির ডেরায় পৌঁছালাম আমরা। আমি মিষ্টি খেতে পারি না। একটা খেলেই গা গুলায়। বমি আসে। নাহিদ ভাইয়ার মামুর আদেশে আমাকে এক বাটি মিষ্টি আর লুচি দেওয়া হলো।
আমার কোনো আপত্তিই ধোপে টিকলো না। গাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে মিষ্টিতে মনোযোগ দিতে গিয়েই খেয়াল করলাম, নাহিদ ভাইয়া আমার দিকে চেয়ে আছেন। নির্নিমেষ উদাসী দৃষ্টি। নির্মল শুদ্ধ কিছু অনুভূতি। আমি আবারও অস্বস্তির সাগরে ডুবে গেলাম৷ মিষ্টিমুখে দেওয়ার আগেই গা গুলালো। খাবারের প্লেটটা ফিরিয়ে দিয়ে হেডরেস্টে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে কী একটা বাঁধ দেখতে নিয়ে গেলেন মামা। এই মুহূর্তে বাঁধটার নাম কিছুতেই মাথায় আসছে না। বিস্তৃর্ণ খোলা জায়গায়, শরীর শীতল করে দেওয়া হু হু বাতাসে মন ভালো হয়ে গেল আমার। ভাইয়ার হাত দুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুদিন পর আবারও বাচ্চামো জাগলো মনে।
বাঁধের এ পাশ থেকে বহুদূরে ভারতের সীমান্ত চোখে পড়ে। সারিবদ্ধ শ’খানেক আলো জ্বলছে ওই দূরের সীমান্তটায়। এই নিয়েও ভাইয়াকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে তুললাম আমি। অ-নে-ক-টা সময় বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে থেকে মনটা যখন ঝরঝরে হয়ে গেল। তখনই শীতের কুয়াশার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে আসতে লাগল অন্ধকারেরা। ভীষণ বিষণ্ণ মন খারাপেরা। আমি আবারও এলোমেলো হয়ে গেলাম। বুকের ভেতর হুহু করে উঠল।
পরিচিত এক শূন্যতায় ডুকরে উঠল মন। সবকিছু অসহ্য ঠেকল। মরণ অসহ্য ঠেকলো। অসহ্য ঠেকলো ভালোবাসা। আবারও যেন ব্ল্যাকআউট হয়ে গেলাম আমি। চারপাশের কিচ্ছুটি খেয়াল রইল না। হঠাৎ এক ঝাঁকুনিতে বাস্তবে ফিরে এলাম আচমকা। মন খারাপের অন্ধকারগুলো কেটে গেল। মাথা ঘুরিয়ে চাইতেই নাহিদ ভাইয়াকে চোখে পড়ল। উনি আতঙ্কিত কন্ঠে বললেন,
‘ কী করছ? আরেকটু হলেই তো নদীতে পড়তে। দেখে হাঁটো।’
হঠাৎ ঘুম ভাঙার মতোই যেন চটক ভাঙল আমার। আশেপাশের সব কেমন অপরিচিত ঠেকলো। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে চেয়ে দেখলাম মৃদু অন্ধকারে দূরে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর মামুর সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে ভাইয়া। আমার দিকে নজর নেই। আমি ভয়ার্ত চোখে নাহিদ ভাইয়ার দিকে চাইলাম। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম অনেকটা সময়। সত্যিই যদি পড়ে টড়ে যেতাম? কী হতো তখন? মরে যেতাম বুঝি? নাহিদ ভাইয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে চাইলেন। বললেন,
‘ কালকের পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমার ভার্সিটিতে তোমার জন্য একটা সীট বরাদ্দ আছে। একটু মন দিয়ে পরীক্ষা দিও? প্লিজ!’
বাক্যের শেষে ‘প্লিজ!’ শব্দটা বড়ো বাহুল্য ঠেকলো আমার কানে। আমি কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ চেয়ে রইলাম। জবাব দিলাম না। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, আমি অবশ্যই রাজশাহীতে পড়ব না। কিছুতেই না। পৃথিবী এফোঁড়ওফোঁড় হলেও না। নাহিদ ভাইয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘ তুমি একটু বড় হয়ে গেছো মনে হচ্ছে? এই মাসখানেকের মাঝেই কেমন একটা গম্ভীর গম্ভীর ভাব চলে এসেছে। বিয়েশাদি করে ফেলার চিন্তা করছ না তো মনে মনে?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কেঁপে উঠল বুক। মুখ ফুটে বলতে পারলাম না, বিয়ে নয় ডিভোর্সের পরিকল্পনা চলছে মনে মনে। পরেরদিন রাজশাহীর পরীক্ষা হলো। পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই নাহিদ ভাইয়া উদ্বিগ্ন প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ পরীক্ষা কেমন হলো?’
আমি নাহিদ ভাইয়ার মুখের দিকে চাইলাম। চিন্তায় কালো হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মায়া হলো। তবুও অকপট স্বীকারোক্তি টানলাম,
‘ পরীক্ষা ভালো হয়েছে। সিক্সটি ফোর মার্কস থাকবে কিন্তু চান্স হবে না। প্রশ্ন সহজ ছিলো। ওয়েটিং এ ঝুলে থাকব।’
নাহিদ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভাইয়ার মাঝে পরীক্ষা নিয়ে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খুব সাধারণভাবে শুধাল,
‘ ক্ষুধা পেয়েছে? কিছু খাবি?’
আমি চুপচাপ মাথা নাড়লাম। সেদিন বিকেলের বাসেই ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা। গোধূলি বিকেলের নরম আলো এফোঁড়ওফোঁড় করে শা শা করে ময়মনসিংহের পথে ছুটল আমাদের বাস। একসময় সন্ধ্যা গড়াল। রাত নামল। বাঁধনহারা চুলগুলো হাওয়ায় উড়লো।
মুঠো ফোনে সময় দেখতে গিয়ে জ্বলজ্বলে তারিখটিতে চোখ আটকে গেল, পাঁচ অক্টোবর। দীর্ঘ মানসিক টানাপোড়েন, রাগ, অভিমান, বিষণ্ণ বিষণ্ণতা ছাপিয়ে বহুদিন পর শুভ্র ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল আমার। আজ তার জন্মদিন ছিলো। ঠিক এক বছর আগে আজকের রাতটিই কত অন্যরকম ছিলো। আমি গ্যালারি খুঁজে পেতে এক বছর আগের এক ছবি পেলাম। ছবিটিতে শুভ্র ভাই হাসছেন। মামনিকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে তৃপ্তি নিয়ে হাসছেন। চিন্তার রেলগাড়ী ছুটতে ছুটতে মামানির কথাও মনে পড়ে গেল আমার। মমতাময়ী মামানীর সাথে বহুদিন কথা হয় না।
নিজের বিপর্যস্ত মানসিকতার টানাপোড়েনে তার কথা অনেকদিন হলো মনে পড়ে না। মনে পড়ে না শুভ্র ভাইয়ের কথা। আচ্ছা, কেমন আছেন তিনি? কোথায় আছেন? শুনেছি দেশ ছাড়ার পর দেশের কারো সাথেই ন্যূনতম সৌজন্যতা রক্ষা করেননি তিনি? কারো সাথে একবিন্দু যোগাযোগ রাখেননি? অব্যবহৃত ফেসবুক একাউন্টটা ডিলিট করে দিয়েছেন চিরতরে। হোয়াটস্অ্যাপ একাউন্টটাও হাওয়া। তার সাথে যোগাযোগ করার কোনো নাম্বার কারো জানা নেই। আপাতত কাজিন গ্রুপের জানা নেই। শুভ্র ভাইয়ের বন্ধু তুষার ভাইয়ারও জানা নেই।
কোনো আত্মীয়-স্বজন কারো কাছেই নেই তার খবর। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বৃষ্টিভেজা তীক্ষ্ণ হওয়াগুলো মুখের উপর সপাটে আছড়ে পড়তেই জীবনের প্রথমবারের মতো তাকে নিয়ে খুব চিন্তা হলো, এভাবেও বুঝি হারিয়ে যাওয়া যায়? নিজের আত্মীয়-স্বজন, কাছের মানুষগুলোকে কী এভাবেও এড়িয়ে চলা যায়? ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে বিরতিহীন ছুটছে বাস। রাত গভীর হচ্ছে। ঘুমে নিমগ্ন হচ্ছে সবাই। কেবল আমিই ঘুমোতে পারলাম না। বারবার মনে পড়ল শুভ্র ভাইয়ের কথা। মনে মনে ভীষণভাবে উপলব্ধি করলাম, ‘শুভ্র নামক বিষ একবার যে পেয়ে যায়। একবার যে ছুঁয়ে যায়।
শুভ্রহীন বেঁচে থাকা তার জন্য অসম্ভব। ড্রাগের মতো সুদূর প্রসারি তার নেশা। প্রতিটি রক্ত কণিকায় কেবল তাকেই পাওয়ারই আন্দোলন।’ আমার বুক ফোঁড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। আচ্ছা? শুভ্র ভাইয়ের কী আমাকে একটুও মনে পড়ে না? নাকি তাসনিম আপুর মতো আমাতেও প্রচন্ড বিরক্ত সে? এইযে আমি এতো পাগল পাগল হচ্ছি, এসব শুনলে তাসনিম আপুর মতোই বুঝি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকাবে তার? ‘ফালতু’ বলে পাশ কাটাবে? সেখানে কী তার নতুন কেউ হয়েছে? পরির মতো সুন্দর কেউ? কোনো এক অবসরে যাকে শুনাবে আমার হৃদয় ভাঙার গল্প? আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্প?
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ বিঃদ্রঃ খুব অগোছালো লিখেছি। এতোগুলোদিন সময় নিয়েও অনুভূতিগুলো গোছাতে ব্যর্থ হয়েছি। সেজন্য দুঃখিত। অনেক লিখেছি। কেটেছি। তবুও হয়নি। এতোটা লেখার পরও আরও অনেকটা বাকি পড়ে আছে। এই পর্বে যতটুকু লিখব ভেবেছিলাম এতোবড় পর্বে ততটুকুও উঠে আসেনি। ব্যাপারটা দুঃখজনক।]