#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ৯
নীলাভ্র জহির
নার্গিসকে দেখে চিত্রার পুরো শরীর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মনের সন্দেহটা আরো তীব্র হলো এবার। একবার রূপকের দিকে আরেকবার নার্গিসের দিকে তাকাল চিত্রা।
রূপক চিত্রাকে বলল, উনারে সালাম করো। উনি সম্পর্কে আমার চাচি হয়।
শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো চিত্রা। নার্গিসকে বিয়ে করলে এই মহিলা তার শাশুড়ী হতো। নিশ্চয়ই নার্গিস আর রুপক বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। এই মহিলা হয়তো সবই জানেন। তাকে মোটেও সালাম করতে ইচ্ছে করলো না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিত্রা উঠে এসে সালাম করলো মহিলাকে।
জোসনা হারিকেন নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। সেই আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চিত্রার মুখখানা। নার্গিসের মা চিত্রাকে ভালো করে লক্ষ করলেন। শুকনো মুখে হাসি টেনে এনে বললেন, মাশাআল্লাহ বউ তো অনেক সুন্দরী।
চিত্রা শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। জোসনা মহিলাকে বললেন, ঘরের ভিতরে আইসো নাসিমা।
– ভিতরে আইজ আর যামু না। এক জায়গায় কামে গেছিলাম। নার্গিস কইলো চলো বউ দেইখা যাই।
চিত্রা বাঁকা চোখে একপলক নার্গিসকে দেখে নিল। এসময় নার্গিস এসে দাঁড়াল তার পাশে। হাসিমুখে বলল কেমন আছেন ভাবী?
গা জ্বলে গেল চিত্রার। আবার তাকে ভাবি বলে ডাকা হচ্ছে? সে আড়চোখে রূপক ও নার্গিসের চোখাচোখি খেয়াল করছিল। বেশ কয়েকবার যোগাযোগই হয়েছে তাদের। নিশ্চয়ই এর ভিতরে কিছু একটা আছে।
উত্তর না দিলে বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাই চিত্রা বলল, জিবভালো আছি। আপনে কেমন আছেন?
ভালো।
কথাটা বলেই নার্গিস আবার রূপকের দিকে তাকালো। কষ্ট হচ্ছে চিত্রার। তার স্বামীর সঙ্গে কি এখনো নার্গিসের কোন সম্পর্ক আছে? এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। চিত্রা বলল, আমি একটু আসতেছি।
কথাটা বলেই ঘরে প্রবেশ করল সে। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রুপক ঘরে ঢুকে বলল, কি গো বউ চইলা আইলা ক্যান? তাদের লগে৷ কথা কও।
চিত্রা বাঁকা চোখে রূপকের দিকে তাকালো। কিন্তু অন্ধকারে তার অগ্নিদৃষ্টি রূপক দেখতে পেল না।
রূপক বলল, চাচিরে পানের খিলি বানাইয়া দেও।
রাগী মুখে উঠে গেল চিত্রা। তার শ্বাশুড়ীর পানের ডিব্বা থেকে সে খিলি পান বানিয়ে নার্গিসের মায়ের হাতে দিল।
সে মুহূর্তে জোসনা বললেন, খালি হাতে কেউ পান দেয়? পানের বাটা দেখো নাই? পিরিচে কইরা দিতে পারতা।
নার্গিসের মা বললেন, থাক সমস্যা নাই। আমরা কি আর মেহমান নাকি?
– সবকিছু তো শিখতে হইব। এরপর থাইকা কাউরে খালি হাতে পান দিবানা। পিরিচে কইরা পান-সুপারি সাজাইয়া তারপর দিবা। পান দেওনের আগে ভালো কইরা ধুইবা। দেখবা পানির মধ্যে কোন ময়লা আছে কিনা।
চিত্রা মাথা নিচু করে রইল। তার মুখটা কাউকে দেখাতে চায় না বলেই হয়তো লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিল।
রূপক জিজ্ঞেস করল, কি অবস্থা নার্গিস ?
নার্গিস বলল, জি ভালো। আপনের কি অবস্থা?
– অবস্থা ভাল। ব্যবসাপাতি ভালো যাইতেছে না। ভাবতাছি দর্জিগিরি শিখমু।
– শিখেন । আমরা একটু কম টাকায় জামাকাপড় বানাইতে পারমু।
চিত্রার গা জ্বলে গেল কথাটা শুনে। নার্গিস নিশ্চয়ই রূপকের দোকানে জামা বানাতে দিতে যাবে। তখন জামার মাপ নেয়ার উসিলায় নার্গিসের গায়ে হাত দিবে রূপক। বিভিন্ন জায়গায় ফিতা ধরে বিভিন্ন অংশের মাপ নিবে। সেই দৃশ্যটা কল্পনা করেই ওর গায়ে আগুন লেগে গেল।
চিত্রা বলল, আজ আমার খুব মাথা ব্যাথা করতাছে আম্মা । আমি একটু ঘরে গিয়া শুইয়া থাকি?
– মাথাব্যথা কেন করব? সব চিন্তা তো আমার পোলার। তুমি তো আরামে খাওয়া-দাও আর ঘুমাও। তোমার কি জন্য মাথা ব্যথা করব?
নার্গিসের মা বললেন, জোসনা বউয়ের লগে এমন কেন করো? মাইয়াডা তো ভালো। খুব লক্ষ্মী মনে হইতাছে।
– হ লক্ষীই তো। বিয়া হইলো, ব্যবসা-বাণিজ্যর ব্যাবাগ খারাপ হইয়া গেল।
জোসনার কথাগুলো বরাবরই বিষের কাটার মত চিত্রার গায়ে বিঁধে। তার মায়ের কথা বলার ধরণ এরকম বলেই হয়তো রূপক বিয়ের রাতে তাকে সচেতন করে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে ওয়াদা করে নিয়েছে যেন তার মাকে সে কখনও আঘাত দিয়ে কিছু না বলে।
জোসনা বললেন , তুমি দাঁড়াই আছো ক্যান? বসো এইখানে?
বারান্দায় পার্টির উপর বসে পড়লেন নার্গিসের মা। চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার নিচে। চিত্রাকে ইশারায় বসতে বললেন তিনি। রূপক বসে আছে পাটিতে। তার দৃষ্টি তখন নার্গিসের দিকে। চিত্রার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। সে হঠাৎ রূপককে বলল, আমার ভাইয়ে কল দিছে?
না তো।
কল দেয়ার কথা ছিল। জানাইছে কিছু?
না,
জোসনা ধান ঘরে তোলার ব্যাপারে নার্গিসের মায়ের সঙ্গে গল্পগুজব করছিলেন। এরই ফাঁকে একবার নার্গিস তার মাকে তাগাদা দিলেও বাড়ি ফেরার জন্য। চিত্রা মনে মনে বলল, বাড়ি ফেরার কি দরকার? এখানে থাকতে তো বড়ই ভালো লাগতাছে মনে হইতাছে।
নার্গিসের মা উঠলেন। চিত্রার হাত ধরে বললেন, থাকো জাইগা। আমাগো বাড়িতে আইসো।
নার্গিস নিজেও চিত্রাকে বলল, আইসেন ভাবি।
ভদ্রতার খাতিরে চিত্রা মাথা নাড়িয়ে ম্লান হাসলো। বলল, আপনারাও আবার আইসেন।
কিন্তু মনে মনে সে তখন বলছে, আর জীবনেও যেন আপনার মুখ দেখতে না হয়। তার স্বামীর পুরনো প্রেমিকাকে দ্বিতীয়বার দেখার কোন ইচ্ছাই তার নেই।
নার্গিস ও তার মা বেরিয়ে গেলে চিত্রা উঠে পড়ল ঘরে ঢোকার জন্য। ঘরে আসার পরে শুনতে পেল জোসনা বেগম বললেন, একই গ্রামে থাকি। ওদেরকে তো আসতে মানা করতে পারি না। তোর সাথে নার্গিসের দেখা হইলে কইবি আমাগো বাড়িতে যেন আর না আসে। ঘরে নতুন বউ। বউ কিছু জানতে পারলে কষ্ট পাইব। সংসারে অশান্তি হইবো।
রূপক কোন উত্তর দিল না। এই প্রথম জোসনা বেগমের প্রতি এক ধরনের সম্মান জাগ্রত হল চিত্রার। ভালবাসতে ইচ্ছে করলো শাশুড়ি মাকে। তার শ্বাশুড়ীর কড়া মেজাজ হলেও মনটা অনেক ভালো মনে হচ্ছে। চিত্রা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল মনে মনে।
রূপক ঘরে এসে দেখল চিত্রা বিছানায় শুয়ে আছে । পুরো ঘর অন্ধকার । রূপক চিত্রার পাশে শুয়ে বলল, ছবি দেখবা বউ। আসো একলগে ছবি দেখি।
চিত্রা চোখ বুজে আছে। কথা বলার মত এখন মেজাজ নেই। রুপক তার বউয়ের বাহুতে হাত রেখে বলল, কি হইছে তোমার?
চিত্রা বলল, কিছুই হয় নাই।
তোমার নাকি মাথাব্যথা করতাছে। খাড়াও তোমারে বাম আইনা দেই।
চিত্রা অভিমানী গলায় বলল, বামে তো মাথা ব্যথা দূর হয়। বুকের ব্যথা দূর হয় কেমনে?
রূপক খিলখিল করে হাসতে হাসতে চিত্রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল বুকের ব্যথার মলম তো আমি। আসো মালিশ কইরা দেই।
দেন।
রূপক আস্তে করে চিত্রার বুকে হাত রাখল। শিরশির করে উঠল চিত্রার শরীর। সে বলল, কি করতাছেন আপনে!
বুকের ব্যথা দূর কইরা দিতাছি।
আপনেরে কইলাম মাথা ব্যথা দূর কইরা দিতে। বুকের যেইখানে ব্যথা করতাছে ওইখানে আপনার হাত যাইবো না।
কি কও? আমি নিভাইতে পারুমনা এমন কোনো ব্যথা আছে তোমার?
থাকবো না কেন? নিজে নিজে ভাইবা দেখেন তো আমি কেমনে কষ্ট পাইতে পারি?
রূপক কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর হয়ে রইল। কেবল দুইজনের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা গেল না।
অনেকক্ষণ পর রূপক নিজে থেকে বলল, তোমার মনে অশান্তি কার জন্য? কেউ তোমারে কিছু কইছে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিত্রা উত্তর দিল, হ কইছে।
কে কি কইছে? আমারে খুইল্লা কও তো।
চিত্রা কথায় কথায় বলে ফেলল, সীমা কইছে আমারে।
খুব সম্ভবত এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা রূপক আন্দাজ করতে পারল। গম্ভীর হয়ে গেল সে। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। চিত্রা বলল, সীমা আমারে কি এমন কইতে পারে আপনি কন দেহি। আমি তো নতুন বউ। আপনারে ছাড়া আমার শাশুড়িরে ছাড়া আর কাউকে চিনি না। আপনের এলাকার একটা মাইয়া কি এমন আমারে কইতে পারে।
রূপক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি বুঝছি বউ। আর কইতে হইবো না।
চিত্রা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তাইলে আপনে কন আমার বুকের ব্যাথা আপনি দূর করতে পারবেন কিনা?
– আগে খোলাখুলি কও তো সীমা তোমারে কি কি কইছে?
– কইছে আপ্নেরে আঁচলে বাইন্ধা রাখতে। একটু নজর রাখতে কইছে।
রূপক বিষন্ন হয়ে গেল। চিত্রা খুব ভালো ও হাসিখুশি একটা মেয়ে। প্রথম দিন থেকেই চিত্রা চেষ্টা করছে তার স্বামীকে যথাসাধ্য খুশি রাখতে। অথচ একটা মেয়ে এসে তার সংসারে অশান্তির ঘি ঢেলে দিয়ে গেছে। একজন নতুন স্ত্রীকে কেউ যদি তার স্বামীকে চোখে চোখে রাখতে বলে তাহলে সেই স্ত্রী স্বামীকে সন্দেহ করবে এটাই স্বাভাবিক।
রূপক মুচকি হেসে বললো, মন খারাপ কইরোনা। মাইয়া মানুষরা একটু বেশি চিন্তা করে। সেই জন্য তোমার একটু সতর্ক কইরা গেছে ।
চিত্রা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, তাইলে তো হইতোই । আপনি কি ভাবছেন নার্গিসের লগে আপনার সম্পর্কের কথা আমি শুনি নাই?
এতক্ষণে নড়েচড়ে উঠলো রূপক । চিত্রার কানে তাহলে এই কথাটাও চলে গেছে? চিত্রার দুঃখের যৌক্তিকতা বুঝতে পেরে বলল, তোমারে সবকিছু খুইলা কই। আগে কও তুমি আমাকে ভুল বুঝবা না তো?
– আপনি যা বুঝাইবেন তাই বুঝবো।
– এগুলা কেমন কথা বউ? আমি ছেলেটা কিন্তু খারাপ না।
– আমিও তো তাই জানি। তো আমারে এমনে কইয়া গেল কেন?
– আমার নার্গিসের লগে রিলেশন আছিল। বেশি দিনের না। আমি ওরে পছন্দ করতাম। সেও আমারে পছন্দ করত। আস্তে আস্তে একটু রিলেশন হইছিল আর কি। তেমন কেউ জানে না। সীমা, রুবিনারা জানতো। কিন্তু সীমা যে এই কথা তোমার কানে আইসা লাগাইয়া দিয়া যাইবো সেইটা কেমনে কই?
আম্মা জানত না?
আম্মারে কইছিলাম যে আমি নার্গিস রে বিয়া করতে চাই। আমার আব্বা আম্মা কেউ রাজি ছিল না। তারপর থাইকা আস্তে আস্তে নার্গিসের লগে আমার লাইনটা কাইটা গেছে।
– সত্য কইতাছেন? লাইন কাইটা গেছে?
– হ, তোমারে ছুইয়া কইতাছি।
চিত্রার শরীর ছুঁয়ে কথাটা বলল রূপক। এতক্ষণে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল চিত্রা। সে বলল, তার লগে এখন আপনার যোগাযোগ নাই?
– না, মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হইলে একটু কথাবার্তা কই। সাধারণ কথাবার্তা। যেহেতু আমাগো রিলেশনের কথা কেউ জানতো না তাই কাউরে কিছু বুঝতে দেইনা।
নার্গিসরে যখন ভুইলা গেছেন আপনার কষ্ট হয় নাই?
সেতো মেলা আগের কথা। ওর লগে কথাবার্তা বন্ধ হইছে মেলা দিন আগে। কষ্ট একটু হইছিল। কিন্তু কিছু করার নাই।
কাল রাইতে আপনারে কে ফোন দিছিল?
সদর থাইকা মাহাজন কল দিছিলো।
সত্য কইতাছেন?
হ, তুমি কি আমার বিশ্বাস করো না? মাহাজন কল দিছিলো। জরুরী আলাপ।
তাইলে আপনি রাইতে বাইরে গিয়া কথা কইলেন ক্যান?
ওরে আমার বউরে।
শব্দ করে হেসে উঠলো রুপক। তার হাসির সঙ্গে চৌকি কাঁপতে লাগলো। এতটা উচ্চশব্দে সে হাসছে।
চিত্রা ভয়ভয় গলায় বলল, আস্তে হাসেন। জোরে হাসলে আব্বা আম্মা রাগ করে। আপনি তো বাড়িতে থাকেন না, আমার লগে চিল্লাচিল্লি করে।
রূপক বলল, কেমনে আস্তে হাসমু কও। আমার হাবাগোবা বউটা যে আমারে এত সন্দেহ কইরা বইসা রইছে শুনলে তো হাসি পাইবোই। জরুরি আলাপ ছিল। আরে ঘরের মধ্যে কল দিলে নেটওয়ার্কে সমস্যা করে। কথা ভালোমতো বুঝা যায় না। এইজন্যে ঘরের বাইরে গিয়া কথা কইছি। উঠান থাইকা ভালো নেটওয়ার্ক পায়। তুমি কি ভাবছো আমি নার্গিসের লগে কথা কইছি? হাহাহা।
শব্দ করে হাসতে লাগল রূপক। ভীষণ লজ্জা পেল চিত্রা। এর আগে কখনো এতটা লজ্জায় পড়তে হয়নি তাকে। এই অন্ধকারেও লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে না পেরে চিত্রা চুপ করে রইল।
রুপক বলল, আমি তোমার স্বামী। ভালো মন্দ কিছু শুনলে তুমি সবার আগে আমারে কইবা। তুমি কেন মানুষের কথায় কান দাও? কেউ যদি আইসা তোমারে কয় রূপকের আর একটা বউ আছে দুইটা বাচ্চা আছে তুমি কি বিশ্বাস করবা?
না, আপনি ওইরকম মানুষই না।
আমি যদি ঐরকম মানুষ নাই হই তাইলে ঘরে বউ রাইখা আরেকজনের লগে আমি পিরিত করমু?
কথার যুক্তিতে চিত্রা লজ্জা পেয়ে গেল। সত্যি তো তাই। তার স্বামী বড় ভালো মানুষ। তাকে খুশি রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে ছেলেটা। মিছেমিছি রূপককে ভুল বোঝা তার উচিত হয়নি। চিত্রা লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, আমার ভুল হইছে। আপনি আমারে মাফ কইরা দেন।
ঠিক আছে বউ। মাফ কইরা দিলাম। কিন্তু এর পরেও যেন আর কোনদিন আমারে ভুল বুইঝা মুখ আন্ধার কইরা থাকতে না দেখি।
দেখবেন না।
হইছে । এখন আসো ছবি দেখি।
চিত্রা রূপকের কাছাকাছি চলে এলো। একই বালিশে মাথা রেখে রূপকের মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো সে। আজ কেবল মাত্র সন্ধ্যা পেরিয়েছে। সিনেমা দেখার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে আজকে। সেদিনের মত আর ভোররাত হয়ে যাবে না।
কিন্তু সেগুড়ে বালি। খানিক বাদেই চিত্রার শশুর বাড়ি ফিরলেন। মাছ নিয়ে ফিরেছেন তিনি। মাঝারি আকারের বেশ কয়েকটা সিলভার কার্প মাছ। রূপক চিত্রাকে অনুরোধে সুরে বলল, বৌ মাছটা তুমি কাটো গিয়া। আম্মারে কাটতে কইও না।
আচ্ছা, যাইতাছি।
অন্ধকার রান্নাঘরের পাশে কুপির আলোয় বসে মাছ করতে শুরু করলো চিত্রা। এত রাতে এই মৃদু আলোয় মাছ কাটতে তাকে বেশ বেগ পেতে হল। পিচ্ছিল মাছগুলোকে ছাইয়ের সঙ্গে ঘষে ঘষে তারপর কাটতে হচ্ছে। তবুও শঙ্কা হাতের নখ যেন কেটে না যায়। কারণ কাটা হাত নিয়ে সংসারের কাজকর্ম করাটা খুব কষ্টদায়ক। নতুন বিয়ে হয়েছে তার। এখন আঙ্গুল কেটে ফেলে কাজকর্ম না করে বসে থাকলে শাশুড়ি মা নানান কথা বলবেন।
চিত্রা খুব সচেতনভাবে মাছ কেটে যাচ্ছে। রূপক একটা মোড়া নিয়ে তার পাশে বসলো। সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষেই দূর হয়ে গেল তার। এমনিতেই এখন তার ভীষন ভালো লাগছিল। মনটা অনেক ফুরফুরে ছিল। রূপক সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়ায় আনন্দ নিয়ে সে মাছ কাটতে বসেছিল। কিন্তু অন্ধকারে মৃদু আলোয় মাছকাটা মোটামুটি কষ্টের কাজ। রূপক পাশে এসে বসায় সেই কষ্টটা যেন মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
রূপক বলল, তুমি হাতে কাচের চুড়ি দেও না কেন? ঝনঝন কইরা বাজবো।
খালি ঝনঝন করলেই তো হইবো না। সংসারে অনেক কাম করতে হয়।
সংসারে থাকলে তো কাম করতে হইবোই। মানুষ হইয়া জন্ম হইলে কাম করতেই হইব। গরু-ছাগলের তো কোন কাম নাই।
চিত্রা হাসতে হাসতে বললো, আমরা গরু ছাগল হইলে কি ভালো হইত?
না, খুব খারাপ হইত। তখন আমি একা একা তোমারে আদর সোহাগ করতে পারতাম না। আরো অনেক গরু করত।
চিত্রা জিব্বায় কামড় দিয়ে বলল, ছি ছি খারাপ কথা কন কেন? আপনি এমন ক্যান?
শব্দ করে হেসে উঠল রূপক। চিত্রা একটা মাছ দিয়ে রূপকের দিকে মাইর দিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, হাইসেন না। আব্বা বাড়িতে আছে।
আচ্ছা, ঠিক আছে। হাসলাম না। এখন তাইলে বইয়া বইয়া কান্দি।
না, কাইন্দেন না। কানলে আপনার আব্বা আম্মা কইবো আমি জানিনা কি করছি?
করছো তো। মাছ দিয়া মাইর দিছ।
আপনে এমন ক্যান?
রূপক হাসতে শুরু করল। চিত্রা চোখ রাঙালে হাসতে হাসতে নিজের মুখ নিজে টিপে ধরল রূপক। তারপর বললো হইছে আর শব্দ কইরা হাসুম না। হাসি হজম কইরা ফেলমু। তারপর সারারাত ঠাস ঠাস কইরা পাদ দিমু।
চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, আপনে ঘরে যানতো। খালি শয়তানি করেন আমার লগে।
তোমার লগে করুম না তো কার লগে করুম। আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ।
মানুষের কি দশটা বউ হয়?
কতজনের হয়। সবাই কি আর আমার মত ভাল হয়?
হইছে হইছে নিজের গুণগান নিজেরে গাইতে হইব না। আপনি এখন এখান থাইকা যান। আমারে কাম করতে দেন।
আমি কি তোমারে ধইরা রাখছি?
চিত্রা কোন উত্তর দিল না। এই মানুষটা এরকমই। হাসি রসিকতা সোহাগ ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছে। বিধাতা যেন এই সুখ সারাজীবন তার কপালে রাখেন। সে বড় সুখী স্ত্রী। এমন সৌভাগ্যবতী কয়জন নারী হতে পারে! ভাবল চিত্রা।
চলবে..